নিম্নবর্ণ আন্দোলন

নিম্নবর্ণ আন্দোলন বাংলায় অস্পৃশ্যদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের রূপ ছিল মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ ভারতের চেয়ে ভিন্নতর। এখানে বর্ণ-কঠোরতা কখনও অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীকে অন্তহীনভাবে দাসত্বের অবস্থায় রাখার মতো প্রবল ছিল না। এ প্রসঙ্গে অনুন্নত বা  তফসিলি সম্প্রদায়এর যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মতো নেতাদের মহারাষ্ট্রের আম্বেদকরের মতো বিশেষ কোন বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়নি।

বাংলার ক্ষেত্রে তফশিলি সম্প্রদায় ভুক্তদের তালিকা শুধু অস্পৃশ্যদেরই অন্তর্ভুক্ত করেনি, সেখানে ধর্মীয় আচারে তাদের চেয়ে এক ধাপ উপরে থাকা বহু অজলচল বর্ণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উপনিবেশিক আমলাতন্ত্র তফসিলি সম্প্রদায়ের অধীনে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে তালিকাভুক্ত করতে তাদের ধর্মীয় আচারগত মর্যাদাকে তেমন গুরুত্ব দেয় নি, সমাজে নিজেদের অর্থনৈতিক মর্যাদাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তারা এ তালিকা তৈরি করেছিল। সুতরাং এমন ভিন্নমত পোষণ করা হয়েছে যে, বাংলায় অস্পৃশ্যতার তীব্রতা ভারতের অন্যান্য কিছু অঞ্চলের তুলনায় দুর্বল হওয়ায় মন্দিরে প্রবেশের মতো আন্দোলনগুলি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের আন্দোলনের কর্মসূচির প্রধান দফা হয়ে উঠতে পারে নি। ফলে নিম্নবর্ণের প্রতিবাদ সব সময় অস্পৃশ্যতার পূর্ণ দূরীকরণ দাবি করে নি। এসব আন্দোলন ছিল সমাজের কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সামাজিক পশ্চাৎপদতা দূরীকরণের প্রচেষ্টার অংশমাত্র। মাসাউকি উসুদার মতো বিদ্বজ্জনরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এসব আন্দোলন যৌথ প্রচেষ্টার রূপ নিয়েছিল যেখানে সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ বর্ণের মানুষও অংশগ্রহণ করেছিল। সমাজের ছোট লোক (নিচ জন্মের) এবং ধনী ভদ্রলোকদের (ধর্মীয় আচারের কারণে মর্যাদা, শিক্ষা ও অন্যান্য গুণাবলির কারণে সমাজে উচ্চতর মর্যাদাভোগী মানুষ) মধ্যে বিরাজমান সক্রিয় বিরোধিতায় অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো সমস্যাগুলির প্রতিফলন ঘটেছিল। কোন কোন সময় বাঙালি অস্পৃশ্যদের মধ্যে আন্দোলন শ্রেণির দ্যোতনা ধারণ করত। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন দুইভাবে এ ধরনের আন্দোলনগুলিকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, কখনো কখনো এ ধরনের আন্দোলনগুলিকে কোন কোন অধস্তন গোষ্ঠীকে অযোগ্য ও বঞ্চিত করার অনুমোদন দানকারী কর্তৃত্বময় সামাজিক সংগঠন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রকাশরূপে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে এ যুক্তিও দেখানো হয়েছে যে, এ ধরনের আন্দোলনগুলিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশরূপেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা ক্ষমতা ও মর্যাদা বণ্টনের বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান ও মর্যাদার পুনর্বিন্যাস চেয়েছিল। এযুক্তি প্রদর্শন করা সময়োপযোগী হবে যে এ ধরনের অস্পৃশ্য সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন স্তরের সামাজিক সচেতনতা এবং বিভিন্ন আকারের রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগের আবির্ভাব ঘটে যা অপরিহার্যভাবে মাত্র একটি আন্দোলনের পরিধির মধ্যে একীভূত হয়ে পড়ে।

বাংলায় নিজেদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার কারণে নিম্ন শ্রেণির অথবা অস্পৃশ্যদের কারও মধ্যে জাতীয়তাবাদীদের চেয়ে মূলগতভাবে ভিন্নতর বৈশ্বিক লক্ষ্যের বিকাশ ঘটে, যার ফলে তারা রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে এ ধরনের আচারগত ‘নিম্ন’ বর্ণের সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিবাদী, কেউ কেউ আপোষকামী এরকম প্রবণতার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটানোর প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নিম্ন বর্ণের সামাজিক প্রতিবাদ তাদের সযত্নে লালিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়।

উনিশ শতকের শেষের দশকগুলি থেকে নিম্নবর্ণের আন্দোলন প্রধানত পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র ও উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। তারাই বাংলার নিম্নবর্ণদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি আন্দোলন সংগঠিত করে। ১৯৩০-এর দশকে এ প্রদেশে নিম্নবর্ণের রাজনীতির আবির্ভাব ঘটলে তারা এর নেতৃত্ব এবং জন-সমর্থনের ভিত্তি দুটিই যোগায়। উপরন্তু, এদুটি সম্প্রদায় মোটামুটিভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। পূর্ববঙ্গে নমশূদ্ররা (১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ২,০৮৭১৬২ জন) ছিল ভূমি-সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত সবচেয়ে বড় বর্ণ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করে ফেলেছিল। একইভাবে উত্তরবঙ্গের প্রধান বর্ণ রাজবংশীরা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছিল এবং সম্ভবত এ থেকে এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দুর্বলতার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

আগে চন্ডাল (অস্পৃশ্যদের বোঝাতে ব্যবহূত সংস্কৃত শব্দ) রূপে পরিচিত নমশূদ্ররা প্রধানত বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলিতে বাস করত। ১৯০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে নমশূদ্র জনগোষ্ঠীর ৭৫% এরও বেশি বাস করত বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং খুলনা জেলায়। বহু গবেষণায় এটাও নির্দেশ করা হয়েছে যে, উত্তর-পূর্ব বাকেরগঞ্জ, দক্ষিণ ফরিদপুর এবং সন্নিহিত নড়াইল, মাগুরা, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলায় এ বর্ণের অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস করত। উত্তর বঙ্গে কোচদের এক অংশ, যারা উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে নিজেদের রাজবংশীরূপে অভিহিত করতে শুরু করেছিল তারাও সন্নিহিতরূপে নির্দেশ করা যায় এমন এলাকায় বাস করত। বিশ শতকের প্রথম বছরগুলির মধ্যেই রাজবংশী জনসংখ্যার ৮৮% এরও বেশি বাস করত রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি এবং ক্ষুদ্র রাজ্য কুচবিহারে। উভয় সম্প্রদায়ের এ ধরনের ভৌগোলিক সংঘবদ্ধতা ছিল তাদের শক্তির প্রধান উৎস। ১৯৪৭ সালে এ ধরনের ভৌগোলিক আবাসভূমি হারানো তাদের আন্দোলনের অবনতিতে অবদান রাখে।

নমশূদ্র এবং রাজবংশী উভয়েরই ছিল অস্পৃশ্যতার কালিমা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত ছিল। এসব কারণেই ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্যদের মতো বাংলার সুবিধাভোগী উচ্চতর বর্ণের সাথে তাদের যথেষ্ট সামাজিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। নিচু সামাজিক অবস্থান ছাড়াও নমশূদ্রদের অধিকাংশই ছিল দখলি সত্ত্বসহ বা দখলি সত্ত্ব ছাড়া ভাগচাষি এবং তাদের কয়েকজন ছিল বর্গাচাষি, যাদের সংখ্যা ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে বাংলার কৃষি সম্বন্ধীয় মৌলিক দ্বি-বিভাজন নমশূদ্রদের ক্ষেত্রে বর্ণ-ক্রমাধিকারতন্ত্রের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। অবশ্য নমশূদ্রদের এক অতি ক্ষুদ্র শ্রেণি সে অঞ্চলে শুরু হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে (অধিকাংশই পূর্ববাংলার ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম-এ তিন বিভাগে) অর্থনৈতিক উন্নতি করে। ফলে কিছু সংখ্যক নমশূদ্র বর্গাচাষি বা ভোগদখলকারী, অন্য কিছু সংখ্যক মহাজনি, কারবারি ও ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। কিছুকাল পরে কেউ কেউ শিক্ষকতা ও অন্যান্য পেশা গ্রহণ করেছিল।

ভূমিসম্বন্ধীয় কাঠামোতে পদমর্যাদায় নমশূদ্রদের চেয়ে অধিকতর ভাল অবস্থানের কারণে রাজবংশীদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। রাজশাহী বিভাগে রাজবংশীরা ছিল খাজনা লাভকারী জনসংখ্যার প্রায় ১০.৬৮%। রাজবংশী কৃষকদের মধ্যে অনেকেই বর্গাচাষি বা আধিয়ার হলেও তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ধনী কৃষক যারা জোতদার এবং চুকমিদার হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ের ভোগদখলের ন্যায়সম্মত অধিকার ভোগ করত। প্রসঙ্গক্রমে, উত্তর বঙ্গের বিশাল অংশে ব্যাপক মাত্রায় জঙ্গল-ভূমি পরিষ্কার করার ফলে রাজবংশীদের দ্বারা কিছু বড় জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে, নমশূদ্র ও রাজবংশী অভিজাতরা নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভ করতে না পারায় এবং কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার ফলে ১৯৩০-এর দশকের সমাপ্তির আগে অভ্যন্তরীণ এসব স্ব-বিরোধিতা প্রধান হয়ে ওঠেনি।

কিছু উদারপন্থী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রভাবে নমশূদ্রদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধের বিকাশ ঘটে। কেশব পাগল বা সাহালাল পীরের মতো ভগবৎ ও আধ্যাত্মিক শক্তিধর গুরুর নেতৃত্বে এসব উদারপন্থী ও প্রগতিবাদী সম্প্রদায় ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ বিশিষ্ট হিন্দু বর্ণপ্রথাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং ভক্তি ও আধ্যাত্মিক আবেগের (ভাব) উপর প্রতিষ্ঠিত সহজ আচরিত নীতিমালার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। ১৮৭২-৭৩ সালে দ্বারকানাথ মন্ডলের নেতৃত্বে নমশূদ্ররা উচ্চবর্ণগুলির সঙ্গে আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের আত্মসম্মানবোধকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। এ আন্দোলনের ব্যর্থতা শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রভাবে একটি সংগঠিত ধর্মীয় উপদল মতুয়া সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। ধনী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী গুরুচাঁদ বর্ণপ্রথার উচ্ছেদ, পুরুষ ও মহিলাদের মমতা এবং পার্থিব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মুক্তির সম্ভাবনার বাণী প্রচার করেন। পরবর্তীকালে ’হাতে কাম মুখে নাম’ (হাতে কাজ কর, মুখে নাম জপ কর) শ্লোগানের মাধ্যমে এ আন্দোলনের বাণী অভিব্যক্তি লাভ করে। প্রায় একই সময়ে প্রভু জগদ্ববন্ধুর মতো (১৮৭১-১৯২১) আরও অনেক নিম্নবর্ণের আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ফরিদপুর ও যশোরে নমশূদ্রদের মধ্যে তাদের শিক্ষাবলির প্রসার ঘটিয়েছিলেন। জগদ্ববন্ধুর শিক্ষাবলি মহান্ত সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরি করেছিল।

নমশূদ্রদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরণ ছিল অন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ব্যাপটিস্ট, অ্যাংলিকান এবং রোমান ক্যাথলিকদের মতো খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলি ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নমশূদ্রকে ধর্মান্তরিত করেছিল।

বিশ শতকের প্রাথমিক বছরগুলি থেকে নমশূদ্র সমিতির প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং বর্ণ আন্দোলনের বার্তা প্রচার ও একে সংগঠিত করার জন্য নিয়মিতভাবে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন সভার আয়োজন করা হয়। একই সঙ্গে যাত্রা এবং মুষ্ঠি সংগ্রহের মতো ব্যাপক জনসংযোগ প্রচেষ্টা প্রায়ই চালানো হয়েছিল। ১৯১২ সাল থেকে বঙ্গীয় নমশূদ্র সমিতি আন্দোলনে একটি অধিকতর আনুষ্ঠানিক বিস্তৃত সাংগঠনিক কর্মপদ্ধতি জুগিয়েছিল। এভাবে আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে সাথে এটা সচেতনতা ও প্রক্রিয়ার দুটি স্বতন্ত্র স্তরকে নিজের মধ্যে বেষ্টন করেছিল। এর একটির প্রতিনিধিত্ব করেছিল অভিজাতরা এবং অন্যটির প্রতিনিধিত্ব করেছিল তাদের কৃষক অনুসারীরা।

রাজবংশীদের ক্ষেত্রে আত্মসম্মানের জন্য আন্দোলন সে সম্প্রদায়ের ধনী সদস্যরা সংগঠিত করেছিল। ১৮৯০-এর দশক থেকে সংস্কৃতায়নের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এবং রাজবংশীদের ব্রাত্য (পতিত) ক্ষত্রিয় রূপে চিহ্নিত করার একটা প্রচেষ্টা চলেছিল। একই সঙ্গে ১৯১২ সাল থেকে শুরু করে অভিজাত রাজবংশীরা তাদের ক্ষত্রিয় মর্যাদা প্রদর্শনের দম্ভে উপবীত ধারণ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। উপরন্তু ভারতীয় ক্ষত্রিয় মহাসভার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টাও চালানো হয়।

বিশ শতকের প্রাথমিক বছরগুলি থেকে নমশূদ্র এবং রাজবংশী উভয়েই তাদেরকে প্রাধিকারমূলক আচরণের আওতায় আনার জন্য ঔপনিবেশিক আমলাদের অনুরোধ জানায়। শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে তাদের প্রতি প্রাধিকারমূলক আচরণ প্রসারিত করা ছাড়াও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারেও উপনিবেশিক আমলাদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করা হয়েছিল। স্থানীয় সংস্থাগুলিতে নমশূদ্র ও রাজবংশী অভিজাতদের অবস্থার উন্নতির চিহ্ন দেখা গেলেও প্রাদেশিক আইনসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব তখনও ছিল ন্যূনতম। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল এই যে, বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধাবলি লাভের উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণের অভিজাত ব্যক্তিরা সচেতনভাবে কংগ্রেসবিরোধী ও ব্রিটিশদের সমর্থনের মনোভাবের প্রবক্তা হয়েছিল। একই সঙ্গে নিম্নবর্ণের ‘এলিট’, বিশেষ করে নমশূদ্র, যারা কংগ্রেসের স্বদেশী আন্দোলন এর সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল তারা ১৯১০ ও ১৯২০ সালের শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবগুলির পরপরই উচ্চকণ্ঠে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মধারার সমর্থন করেছিল। তারা ভারতীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অধিকতর ক্ষমতার বণ্টন চেয়েছিল। মন্ট-ফোর্ড প্রস্তাবগুলির প্রায় পরপরই রাজবংশী ও নমশূদ্র অভিজাতরা বাংলায় অনুন্নত সম্প্রদায়গুলির জন্য অধিকতর প্রতিনিধিত্বের জন্য চাপ দিয়েছিল। এসব দাবির ফলে ১৯১৯-এর আইনে বঙ্গীয় আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণির একজন প্রতিনিধির মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।

১৯২০-এর দশকের প্রথম ভাগ থেকে ব্রিটিশদের প্রতি সমর্থনের মনোভাব আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে এবং নিম্নবর্ণের এলিটগণ অধিকতর রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টায় জাতির পক্ষে কংগ্রেসের বক্তব্য রাখার নীতির বিরুদ্ধে আরও বেশি সমালোচনামুখর হয়ে পড়ে। ফলে এসব এলিটের কাছে জাতীয়তাবাদ ভিন্ন অর্থে দেখা দেয়। হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সমালোচক এবং কংগ্রেস বিরোধী অবস্থানের সমর্থক হলেও তারা কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে ছিল না। অন্য কথায় বলা যায় যে, নিম্নবর্ণের এলিটগণ কংগ্রেস প্রদত্ত নামে মাত্র নাগরিকত্ব দানের নীতির পরিবর্তে প্রকৃত নাগরিকত্বের নীতির ভিত্তিতে একটি জাতির সন্ধান করছিল।

অবশ্য, নিম্নবর্ণের অভিজাতরা পূর্বাপর একই রকমভাবে জাতীয়তাবাদী মূলধারা থেকে পৃথক রাজনৈতিক পথ সমর্থন করেছিল এমনটা অনুমান করা ভুল হবে। মাঝে মাঝে সমকেন্দ্রিকতা ঘটেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২০-এর দশকে কেশবচন্দ্র দাস, মোহনী মোহন দাস এবং উপেন্দ্রনাথ বর্মণের মতো বিশিষ্ট নমশূদ্র ও রাজবংশী এলিটগণ জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করার পক্ষে ছিলেন। বোধগম্যভাবে স্বল্প সুবিধাভোগী নমশূদ্র ও রাজবংশী কৃষকদের মধ্যে কংগ্রেস বিরোধী মনোভাব ছিল প্রবল। কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে নমশূদ্র ও রাজবংশী কৃষকরা উচ্চবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান উভয় নিয়েই গঠিত প্রধান ভূস্বামী শ্রেণির বিরুদ্ধে তীব্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল।

১৯৩০-এর দশকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ সুবিধাদি আসতে শুরু করলে নিম্নবর্ণের এলিটগণ তাদের সমর্থকদের সম্পর্কে ক্রমে অধিকতর অমনোযোগী হয়ে পড়ে এবং আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত রাজনীতি ও শাসনতান্ত্রিক বির্তকে অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের গ্রামীণ সমর্থকদের উপর প্রভাব বজায় রাখতে এ সকল এলিট মাঝে মাঝে কৃষকদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বিষয় তুলে ধরত। আম্বেদকরের ধারার বিচ্ছিন্নতাবাদী নিম্নবর্ণের রাজনীতির প্রতি স্পষ্টভাবে ঝুঁকে পড়ার ফলে ১৯৩০-এর দশকে তাদের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু কৃষকদের সঙ্গে স্পষ্ট সম্পর্কযুক্ত কৃষক প্রজা পার্টির মতো রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয়ের কারণেই প্রধানত ১৯৩০-এর দশকের মধ্যবছরগুলিতে নিম্নবর্ণের এলিটগণ জনসমর্থন হারাতে শুরু করে। তবে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে কৃষক প্রজা পার্টি নিম্নবর্ণ অধ্যুষিত নির্বাচনী এলাকাগুলি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলে এলিটগণ আবার তাদের হূত রাজনৈতিক ভিত্তি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই যে, এ সময়ে কংগ্রেসও নিম্নবর্ণের এলিটদের একাংশের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে নিম্নবর্ণের সদস্যরা বঙ্গীয় আইন পরিষদে ১৫৬টির মধ্যে ৩২টি আসনে জয়লাভ করে। সফল ৩২ জনের এই সদস্যদল রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিবর্তন প্রকাশ করে। ২৩ জন স্বতন্ত্র সদস্য ছাড়াও ৭ জন নির্বাচিত হয়েছিল কংগ্রেসের সমর্থনে এবং হিন্দু মহাসভা সমর্থন করেছিল ২ জনকে।

শ্রেণি বিভক্তি দেখা দিলে ১৯৩০-এর দশকের শেষার্ধ থেকে নিম্নবর্ণের আন্দোলন তার গতি ও স্বশাসনের অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। নিম্নবর্ণের এলিটগণ তাদের গ্রামীণ সমর্থকদের সঙ্গে আর যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে নি। বাজার-মন্দার সূত্রপাত এবং এর ফলে কৃষকদের দুর্দশা বর্ণ নির্বিশেষে গ্রামীণ শ্রমজীবী শ্রেণির এক বৃহৎ অংশকে কিষাণ সভার আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে তোলে। ১৯৪০-এর দশকের প্রথমার্ধের সমস্তটা জুড়েই জলপাইগুড়ি-দিনাজপুর এলাকায় একই বর্ণপরিচয় রাজবংশী জোতদার ও আধিয়ারদের মধ্যে সংঘাত বন্ধ করতে সক্ষম হয় নি। আধিয়ারগণ ফসলের আরও বেশি অংশ দাবি করছিল। বিরোধ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৬-৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলন এ রূপ পরিগ্রহ করে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই যে, কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার সঙ্গে ইনডিপেন্ডেন্ট সিডিউল কাস্ট পার্টির সখ্য স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। বঙ্গীয় প্রাদেশিক সিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাও তৃতীয় বিকল্পের উদ্ভব ঘটায় নি।

বলা যায় নিম্নবর্ণের সম্প্রদায়-পরিচিতিতে সব সময়ই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সচল ছিল, যার ফলে এর খন্ডকরণ ঘটেছিল। বস্ত্তত, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দল ও উপদলগুলি অন্য বড় চিহ্নিত জাতি, ধর্ম বা শ্রেণিগুলির অঙ্গীভূত হয়ে যায়। সে অর্থে বিশেষত ১৯৪০-এর দশকে নিম্নবর্ণগুলি কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদ বা হিন্দু মহাসভা প্ররোচিত সাম্প্রদায়িক অথবা কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন কিষাণ সভার মতো বিভিন্ন আন্দোলনের ধারায় অঙ্গীভূত হয়, যাকে এ ধরনের আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।  [রাজশেখর বসু]

গ্রন্থপঞ্জি  Sekhar Bandopadhyay, Caste, Politics and the Raj, Calcutta, 1990; Namasudras, London, 1998; Usuda Masayuki. ‘Pushed towards the Partition: Jogendranath Mandal and the Constrained Namasudra Movement’ in H Kotani (ed), Caste System, Untouchability and the Depressed, pp 221-274, Delhi, 1997.