নিমতলী দেউড়ি

নিমতলী দেউড়ি  বা নিমতলী গেট মূলত ঐতিহাসিক নিমতলী প্রাসাদের পশ্চিম দিকের তোরণ ছিল। প্রাসাদটি ঢাকার  নায়েব নাজিম  (ডেপুটি গভর্নর) নবাব জসরত খান এর বসবাসের জন্য ঢাকার প্রথম ব্রিটিশ সামরিক শাসক ক্যাপ্টেন আর্চিবল সুইন্টন (Captain Archibald Swinton) এর তত্ত্বাবধানে ১৭৬৫-৬৬ সালে নির্মিত হয়। ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত জসরত খানের উত্তরাধিকারী নবাব হাসনাত জং এবং নবাব নূসরাত জং এর বাসস্থান হিসাবে এই প্রাসাদ ব্যবহূত হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে নিমতলী প্রাসাদটি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তবে দেউড়ি ভবনটি মোটামুটি অক্ষত থাকে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবারই প্রাসাদের মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাসাদের দক্ষিণ অংশ গোপীকৃষ্ট নামে এক ব্রাহ্মণ সেরেস্তাদার ক্রয় করে বিধান পল্লী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে উনিশ শতকের ফরাশগঞ্জের এক ব্যবসায়ী (রূপলাল দাস) প্রাসাদ এলাকার ভূমি ক্রয় করেন। ১৯১৩ সালে লর্ড কারমাইকেল একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার জন্য নবাবদের এ ভূমি অধিগ্রহণ করেন এবং সেখানেই ঢাকা জাদুঘর এর গোড়াপত্তন হয়।

নিমতলী দেউড়ি (সংস্কারের আগে)

নিমতলী প্রাসাদ ঢাকা মহানগরীর নিমতলী মহল্লা এবং হাইকোর্ট ভবনের মাঝখানে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। তন্মধ্যে নিমতলী দেউড়ি বর্তমানে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এর প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে। মূল প্রাসাদের অংশ হিসেবে এখনও টিকে থাকা নিমতলী দেউড়ি, বারদুয়ারী প্রাসাদ (পুরনো জাদুঘর ভবন) এবং নওয়াবী দিঘি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের অভ্যন্তরে অবস্থিত) বা পুকুর থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রাসাদটি মূলত মুগল স্থাপত্যশৈলী অনুসরণেই নির্মিত হয়েছিল। এ প্রাসাদ চত্বরে অনেকগুলি ভবন, একাধিক প্রবেশদ্বার, অভ্যন্তরীণ অঙ্গন, ব্যক্তিগত বাসভবন, প্রার্থনা কক্ষ, হাম্মাম, পানি সরবরাহের নালা, সৈন্যদের বাসস্থান, পুকুর, বাগান ইত্যাদি ছিল।

চার্চ অব ইংল্যান্ডের কোলকাতার বিশপ রেজিনাল্ড হেবার (১৭৮৩-১৮২৬) এ প্রাসাদের কিছু বিবরণ দিয়েছেন। ১৮২৪ সালে তিনি ঢাকা সফরকালে নিমতলী প্রাসাদ পরিদর্শন করেন এবং এর সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ লেখেন। যদিও এসময় প্রাসাদটি ভগ্নদশায় ছিল। তিনি লেখেন ‘... অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রবেশদ্বার (নিমতলী গেট) যার লম্বা বারান্দাগুলি উন্মুক্ত, যেখানে নহবত বা সন্ধ্যাকালে সামরিক বাজনা বাজান হয়- যা ছিল সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক...। অবশ্য যদিও বর্তমানে নবাবের তেমন কোন ক্ষমতাই নেই তবুও কোম্পানি সরকার নবাবকে এই প্রথা অবলম্বন করতে প্রশ্রয় দেয়’।

নিমতলী দেউড়ি (সংস্কারের পরে)

ত্রিতল এবং বহুভূজ (Polygonal) বিশিষ্ট এই দেউড়ির পূর্ব দিকের পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে ১৫.২০ মিটার হলেও পশ্চিম দিকে ৮.১৩ মিটার দীর্ঘ। এর মাঝখানে রয়েছে ৫ মি. প্রশস্ত খিলানযুক্ত একটি পথ। নিচতলায় এই পথের উত্তর দিকে দুটি ও দক্ষিণ দিকে ১টি কক্ষ ও উপর তলায় যাওয়ার সিঁড়ি রয়েছে। দক্ষিণের কক্ষ এবং উত্তর দিকের পূর্ব পার্শ্বের কক্ষটি বর্গাকার এবং এর পরিমাপ ৩.৩৮ বর্গমিটার। উত্তর দিকের পশ্চিম পার্শ্বের অপেক্ষাকৃত ছোট কক্ষটির পরিমাপ ২.৭৪ মিটার x ১.৮২ মিটার। দোতলায় রয়েছে দুটি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষের পরিমাপ ৩.৩৮ মি. x ৩.৩৮ মি.। তৃতীয় তলার একই সমতলে রয়েছে দুটি কক্ষ। তন্মধ্যে পূর্ব দিকের বৃহৎ হলঘরটির পরিমাপ ১৩.৭৫ মি. x ৮.৩০ মি.। অপর কক্ষটির পরিমাপ ৮.২২ মি. x ৪.১৪ মি.। এই কক্ষ দুটির মেঝে থেকে ২ মিটার উঁচুতে সম্মুখ দিকে (পশ্চিমে) অবস্থিত উন্মুক্ত বারান্দার পরিমাপ ৩.৬৫ মি. x ১.৭০ মি.।

ইমারতটিতে যুগপৎভাবে কাঠ, লোহা, ইট, সুরকি ও পাথরের ব্যবহার করা হয়েছে। পাশ্চাত্য প্রভাবপুষ্ট সমতল ছাদের সঙ্গে মুগল ঐতিহ্যের ধারক চতুর্কেন্দ্রিক কৌণিক খিলান ব্যবহূত হয়েছে। তাছাড়াও ঝুলানো বেলকনি সদৃশ্য জানালার ব্যবহার এটিকে ঢাকার স্থাপত্যে ইউরোপীয় শৈলীর অনুপ্রবেশের প্রথম আদর্শ উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ১৮৯৮ সালে ভূমিকম্পের ফলে ভবনটির যে ব্যাপক ক্ষতি হয় তাতে, বিশেষত এর ছাদের কিউপোলাগুলো ভেঙ্গে পড়ে যায়।

নিমতলী দেউড়ি (পিছনের অংশ)

১৯২৫ সাল থেকে ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটরের আবাস হিসেবে দেউড়ি ভবনটি ব্যবহূত হতে থাকে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আবাসগৃহ হিসেবে দেউড়ির ভবন ব্যবহূত হতে থাকে। ১৯৫২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেউড়িটির একটি কক্ষে এর অফিস স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে সমগ্র দেউড়ি ভবন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ক্রয় করে নেয় এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভবনটি সোসাইটির অফিস, লাইব্রেরি ও সেমিনার হল হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। ১৯৮৩ সালে সোসাইটির অফিস ও লাইব্রেরি দেউড়ি থেকে বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হয়।

বিভিন্ন সময়ে অপরিকল্পিতভাবে মেরামত হওয়ায় দেউড়ির আদি বৈশিষ্ট্য হয় বিনষ্ট অথবা নতুন আস্তরে ঢাকা পড়ে গেছে। নিমতলী দেউড়ির প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যিক গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০০২ সালে এই ভবনকে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ হিসাবে সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছে। দেউড়ির বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ হওয়ায় এশিয়াটিক সোসাইটি ২০১০-১১ সালে এর প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ কাজ সমাধা করে এটাকে একটি স্থায়ী জাদুঘরে রূপান্তর করার জন্য কার্যক্রম হাতে নেয়। দেশের প্রথিতযশা সংস্কারবিদ, স্থপতি, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ইতিহাসবিদগণ এ সংস্কার কাজের সঙ্গে জড়িত। ২০১০ সালে প্রত্নত্বাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এর ভিত্তি, বিভিন্ন তলের মেঝে এবং দেউড়ির বিভিন্ন অংশের আদি রূপ বা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে তা যথাযথভাবে দলিলিকরণ করার পর ভিতর ও বাহিরের আস্তরণের কাজসহ অন্যান্য সংরক্ষণের কাজ এগিয়ে চলছে (২০১১)।  [শরীফ উদ্দিন আহমেদ এবং শফিকুল আলম]