নিধুগুপ্ত

নিধুগুপ্ত0 (১৭৪১-১৮৩৯)  সঙ্গীতশিল্পী ও গানের জনক। তাঁর প্রকৃত নাম ‘রামনিধি গুপ্ত’, কিন্তু সঙ্গীতজগতে তিনি ‘নিধু গুপ্ত’ নামেই পরিচিত। কেউ কেউ তাঁকে ‘নিধুবাবু’ বলেও ডাকতেন। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চাপ্তায় মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। পিতা হরিনারায়ণ গুপ্ত পেশায় ছিলেন একজন কবিরাজ এবং তিনি কলকাতার কুমারটুলিতে সপরিবারে বাস করতেন।

নিধু গুপ্ত জনৈক পাদরির নিকট কিছু ইংরেজি শিক্ষার সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসে কেরানির চাকরি পান। এ উপলক্ষে তিনি ১৭৭৬ থেকে ১৭৯৪ সাল পর্যন্ত বিহারের ছাপরায় অবস্থান করেন। সেখানে একজন মুসলমান ওস্তাদের নিকট তিনি হিন্দুস্থানি টপ্পা সঙ্গীতে তালিম নেন। কোম্পানির অফিসে চাকরি করে তিনি প্রচুর অর্থের মালিক হন এবং কলকাতায় ফিরে সম্পূর্ণরূপে সঙ্গীতচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৮০৮ সালে তিনি শোভাবাজারে একটি সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে তরুণদের সঙ্গীত শিক্ষা দেন।

নিধু গুপ্ত বাংলা ভাষায় টপ্পাগীতি রচনা ও সুরারোপ করে নিজেই তা গাইতেন। ক্রমে তাঁর গানের সমঝদার জোটে এবং কলকাতার নগরসমাজে তিনি অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বর্ধমানের মহারাজা তেজেশচন্দ্র রায়বাহাদুর তাঁর গানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।

টপ্পা প্রধানত মার্গরীতির প্রণয়গীতি; ধ্রুপদ-খেয়ালের চেয়েও সংক্ষিপ্ত আঙ্গিকে কেবল অস্থায়ী ও অন্তরা সমন্বয়ে রচিত। নিধু গুপ্ত হিন্দি টপ্পার অনুকরণে বাংলা টপ্পা রচনা করেন, তবে তাতে তাঁর স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে। তিনি বিভিন্ন রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে সুরের মধ্যে বৈচিত্র্য এনেছেন। টপ্পার গায়ন-পদ্ধতি এমনই যে, এর সুরের ভাঁজে ভাঁজে গায়কের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। টপ্পায় বাণীর চেয়ে রাগের কাজ বেশি। এর আলাপি ধরনের সুর শ্রোতার মনে মাদকতা আনে। টপ্পাগানে আদিরসের স্থান থাকলেও নিধু গুপ্ত বিশুদ্ধ মানবীয় প্রেমের গান রচনা করেন। তিনি মাতুল সম্পর্কীয় আত্মীয় কুলুইচন্দ্রের আখড়াই গান সংশোধন করে দিতেন এবং এ গানের উন্নতিসাধনে যথেষ্ট চেষ্টাও করেন।

আখড়াই গান আদিরসাত্মক। নিধু গুপ্তের ভালোবাসার পাত্রী ছিল শ্রীমতী নামে এক রূপবতী ও সঙ্গীতনিপুণা বারাঙ্গনা। তিনি শ্রীমতীর গৃহে উপস্থিত হয়ে তাকে গান শোনাতেন এবং তার সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। তাঁর প্রেমমূলক অনেক টপ্পার প্রেরণার মূলে ছিল এই প্রণয়পাত্রী।

স্বভাবকবির প্রতিভাগুণে নিধু গুপ্তের অনেক গান আধুনিক বাংলা লিরিকের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে। ১৮৩২ সালে গীতরত্ন নামে তাঁর গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়; তাতে ৯৬টি গান স্থান পায়। তাঁর পুত্র জয়গোপাল গুপ্ত ১৮৫৬ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন; তাতে আরও সাতটি গান সংযুক্ত হয়। গীতরত্নের গানগুলির মধ্যে চারটি ভক্তিভাব ও একটি স্বদেশচেতনার গান ছাড়া বাকি ৯৮টি প্রেমবিষয়ক গান। দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত বাঙ্গালীর গানে (১৯০৫) নিধু গুপ্তের ৪৫০টি এবং সঙ্গীতরাগকল্পদ্রুম নামক সংকলনে ১৫০টি গান মুদ্রিত হয়েছে।

নিধু গুপ্ত বাংলা ভাষাবিষয়ক একটি গান রচনা করে স্বদেশপ্রেম ও ভাষাপ্রীতির স্বাক্ষর রেখেছেন। গানটি হলো: ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা\’ সেকালের প্রেক্ষাপটে এরূপ উক্তি দুর্লভ বলেই বিবেচিত হয়। ‘মনোপুর হোতে আমার হারায়েছে মন’, ‘কত ভালবাসি তারে সই, কেমনে বুঝাব’, কেমনে রহিব ঘরে মন মানে না’, ‘এমন সুখের নিশি কেন পোহাইল’ ইত্যাদি তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় টপ্পা গান। [ওয়াকিল আহমদ]