নায়েব নাজিম

নায়েব নাজিম  আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর (১৭০৭) মুগল সাম্রাজ্য ক্রমশ নানা অংশে বিভক্ত হওয়ার ফলে দূরবর্তী প্রদেশগুলির শক্তিমান শাসনকর্তারা নিজ নিজ অঞ্চলে অর্ধ-স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মুর্শিদকুলী খান ছিলেন এসব অসমসাহসিক ও দক্ষ শাসকদের অন্যতম এবং তিনি ছিলেন কার্যত মুগল কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্বাধীন। তিনি বাংলায় একটি অর্ধ-স্বাধীন শাসকগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এ শাসন এক নতুন যুগের সূচনা করে এবং তা বাংলার ইতিহাসে নওয়াবী শাসনরূপে পরিচিতি লাভ করে।

আঠারো শতকের শুরুতে বাংলার বিদ্যমান প্রশাসন নতুন এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। বহিরাগত ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং বিশেষত আফগানদের আক্রমণের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে দূরবর্তী এলাকা শাসনে নওয়াবকে সহায়তা করার জন্য নায়েব নাজিম এর (সুবাহদারের প্রতিনিধি) পদ সৃষ্টি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। উপরন্তু ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসিদের মতো ইউরোপীয় শক্তিগুলির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক স্বার্থ ও বাণিজ্যিক উচ্চাভিলাষ শাসকশ্রেণীকে এক ভীতিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। সমুদ্রপথে বাণিজ্যের প্রসার, অর্থ লেনদেনের জটিল পদ্ধতি এবং রাজস্ব সংক্রান্ত নবতর সমস্যাবলিও মুগল শাসনের শেষের দিকে নায়েব নাজিমের পদ সৃষ্টির জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল না।

১৭০৩ সালে সুবাহদার যুবরাজ আজিমুদ্দীন (পরবর্তীকালে আজিম-উস-শান উপাধিতে ভূষিত) পাটনায় তাঁর প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থানান্তর করলে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকা তার গৌরব হারিয়ে ফেলে। আজিমুদ্দীনের পুত্র ফররুখ সিয়ার সম্ভবত ১৭০৭ সাল পর্যন্ত ঢাকায় বাস করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে নায়েব বা নাজিমের প্রতিনিধির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না, অন্তত সরকারিভাবে তাঁকে সেভাবে অভিহিত করা হয় নি। অল্পকাল পরে মুর্শিদকুলী খানও তাঁর দীউয়ানি কার্যালয় মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। বস্ত্তত, ঢাকা স্থানীয় প্রশাসনিক সদর দফতর এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়।

আজিম-উস-শানের প্রতিনিধিরূপে সরবুলন্দ খান ঢাকার নায়েব নাজিম ছিলেন (১৭০৮-১৭০৯), কিন্তু তিনি থাকতেন মুর্শিদাবাদে। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে ফররুখ সিয়ারের শিশুপুত্র ফরখুন্দসিয়ারের প্রতিনিধিরূপে মুর্শিদকুলী খান নায়েব নাজিম হন। ফরখুন্দসিয়ারের মৃত্যুর পর তিনি মীরজুমলা উপাধিতে ভূষিত শরিয়তউল্লাহর প্রতিনিধিরূপে ঐ পদে বহাল থাকেন। মুর্শিদকুলী খানও মুর্শিদাবাদে বসবাস করতে থাকেন। মুর্শিদকুলী খান বাংলা ও উড়িষ্যার পুরাদস্ত্তর সুবাহদার হলে সম্ভবত ১৭১৬-১৭১৭ সাল থেকে ঢাকা সুবাহদার বা নাজিমের শাসন-প্রতিনিধি নায়েব নাজিমের প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

এ সময় থেকে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দীউয়ানি প্রদান পর্যন্ত (১৭৬৫) ঢাকা ছিল নায়েবী শাসনের কর্মকেন্দ্র। অবশ্য ঢাকার নায়েব নাজিমরা ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। তবে ১৭৬৫ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত তাঁরা ছিলেন ক্ষমতাহীন। ১৮২২ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত তাঁরা ছিলেন নিছক পদবি ও সামান্য ভাতার অধিকারী।

নায়েব নাজিমের কর্মকেন্দ্ররূপে জাহাঙ্গীরনগরের (ঢাকা) সূচনাকালের নায়েব নাজিম ছিলেন খান মুহম্মদ আলী খান (১৭১৭), ইতিশাম খান (১৭২৩-১৭২৬), ইতিশাম খানের এক পুত্র (১৭২৬-১৭২৭) এবং মির্জা লুৎফুল্লাহ্ ওরফে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খান (১৭২৮-১৭৩৩)।

মুর্শিদকুলী খান তাঁর জামাতা সুজাউদ্দীনকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম নিযুক্ত করেন এবং দৌহিত্র সরফরাজ খানকে মসনদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু সুজাউদ্দীন পুত্র সরফরাজকে বঞ্চিত করে সিংহাসন দখল করেন এবং ১৭২৭ থেকে ১৭৩৯ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তাঁর শাসনামলে বিহারকে বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় এবং তিনি প্রশাসনিক সুবিধার্থে গোটা অঞ্চলকে চারটি বিভাগে বিভক্ত করেন। এ বিভাগগুলি ছিল: কেন্দ্রীয় বিভাগ (পশ্চিম বঙ্গ ও উত্তর বঙ্গের অংশ); জাহাঙ্গীরনগর বিভাগ, উড়িষ্যা বিভাগ এবং বিহার বিভাগ। কেন্দ্রীয় বিভাগটি নওয়াব বা সুবাহদার নিজেই সরাসরি শাসন করতেন। অন্য বিভাগগুলি নায়েব নাজিমদের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।

সুজাউদ্দীন জাহাঙ্গীরনগরের শাসনভার তাঁর জামাতা দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খানের উপর ন্যস্ত করেন এবং উড়িষ্যা ও বিহারের দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁর পুত্র যথাক্রমে তকী খান ও সরফরাজ খানের উপর। দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খান শাসক হিসেবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেন এবং মীর হাবিবের সহায়তায় প্রশাসনিক ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেন। তিনি ত্রিপুরার রাজধানী ও সন্নিহিত অঞ্চল আক্রমণ করেন এবং ত্রিপুরার রাজার এক ভ্রাতুষ্পুত্রের উপর অধিকৃত অঞ্চলের দায়িত্ব অর্পণ করে প্রচুর ধনরত্নসহ জাহাঙ্গীরনগরে ফিরে আসেন।

তকী খানের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খানকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হয়। সরফরাজ খানআলীবর্দী খান যথাক্রমে জাহাঙ্গীরনগর ও বিহারের নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। ঢাকায় না এসেও সরফরাজ খান ১৭৩৩ থেকে ১৭৩৮ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। প্রতিনিধি হিসেবে গালিব আলী খান এবং দীউয়ান যশোবন্ত রায়ের সাহায্যে তিনি ঢাকার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। গালিব আলীর শাসনে শায়েস্তা খান এর আমলের অনুরূপ শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করছিল। ব্যবসা ও কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হয় এবং খাদ্যশস্যের মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। গালিব আলী খান ও যশোবন্ত রায় যতদিন জাহাঙ্গীরনগরে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।

নওয়াব সুজাউদ্দীনের পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান (১৭৩৯-১৭৪০) বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নওয়াব হন। তিনি পুরানো রাজকর্মচারীদের স্ব স্ব পদে বহাল রাখেন। এভাবে হাজী আহমদ, আলম চাঁদ, জগৎ শেঠ এবং আরও অনেকে তাঁদের পূর্ব পদে বহাল থাকেন। আলীবর্দী খান বিহারের নায়েব নাজিম পদে বহাল থাকেন। সরফরাজ খানকে উৎখাত করার জন্য সেখান থেকে তিনি তাঁর ভাই হাজী আহমদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হাজী আহমদ নওয়াবের বিরুদ্ধে জগৎশেঠ ও আলম চাঁদকে নিজ দলে নিয়ে আসেন। সরফরাজ খান গিরিয়ার যুদ্ধে (১৭৪০) আলীবর্দী খানের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর মোকাবেলা করে পরাজিত ও নিহত হন। আলীবর্দী খান বাংলা ও বিহারের নওয়াব হন।

নতুন নওয়াব তাঁর সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের (ঘসেটি বেগমের স্বামী) উপর জাহাঙ্গীরনগরের নিয়াবত ন্যস্ত করেন। তিনি তাঁর প্রতিনিধি হোসেন কুলী খান (১৭৪০-১৭৫৪) এবং মুরাদ আলী খানের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগরের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ১৭৫৩ সাল নাগাদ পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগ জাহাঙ্গীরনগরের পরিস্থিতি অমুসলিম কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রাজধানী মুর্শিদাবাদে বসবাসকারী নওয়াজিস মুহম্মদ খান ছিলেন এর নামমাত্র শাসক। নায়েব নাজিম পদে অধিষ্ঠিত প্রধান ব্যক্তির অবিরাম অনুপস্থিতি একটি হিন্দু অভিজাত ও বণিক শ্রেণির বিকাশের সহায়ক হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিন্দু কর্মচারীরা দরবারের রাজনীতিতেও নিজেদের কর্তৃত্ব প্রদর্শন করতে শুরু করে। অন্যায়ভাবে রাজস্ব আত্মসাৎ করে রাজবল্লভ বিশাল সম্পদ ও সম্পত্তির মালিক হন।

আলীবর্দী দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খানের কাছ থেকে উড়িষ্যা দখল করে তাঁর দ্বিতীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও দ্বিতীয় জামাতা সৈয়দ আহমদ খানকে এর নায়েব নাজিম নিযুক্ত করে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। সৈয়দ আহমদ খান সফলভাবে স্থানীয় সমস্যাবলির সমাধান করতে ব্যর্থ হওয়ায় উড়িষ্যায় জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তিনি বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি হলে আলীবর্দী খান তাঁকে মুক্ত করতে অগ্রসর হন। পরবর্তীকালে সৈয়দ আহমদকে উড়িষ্যা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় এবং তাঁর স্থলে পর পর মুখলিস আলী খান ও শেখ মাসুমকে নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হয়। স্থানীয় শাসনকাজ পরিচালনায় নায়েব নাজিমকে সাহায্য করার জন্য জানকীরামের পুত্র দুর্লভরামকে উড়িষ্যার দীউয়ান নিযুক্ত করা হয়।

আলীবর্দী খানের আমলে বিহার ছিল আফগান-বিদ্রোহের লালনভূমি। বিদ্রোহী আফগান নেতা মুস্তফা খান তাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। কিন্তু আলীবর্দী খানের কনিষ্ঠতম ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা জৈনুদ্দীন সাফল্যের সঙ্গে তাঁকে বিতাড়িত করেন। পরাজিত আফগানরা নাগপুরের মারাঠা নেতা রঘুজী ভোঁসলেকে আলীবর্দী খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত করে। কিন্তু তাদের অসৎ অভিসন্ধি সফল হয় নি। পিতৃব্যকে সিংহাসনচ্যূত করে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে জৈনুদ্দীন আফগানদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কিন্তু আফগানরা জৈনুদ্দীন আহমদকে হত্যা করে এবং নওয়াব তাঁর জামাতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। শত্রুদের পরাজিত করে তিনি পাটনায় প্রবেশ করেন এবং জৈনুদ্দীনের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে সেখানকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত করেন। তাঁকে সহায়তা করার জন্য রাজা জানকীরামকে সেখানে নিয়োগ করা হয়।

নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার আমলে (১৭৫৬-১৭৫৭) জসরত খান ছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের নায়েব নাজিম। তিনি দুই মেয়াদে (১৭৫৬-১৭৬২ এবং ১৭৬৫-১৭৭৮) এ পদে বহাল ছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধএর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের অভিযোগে মীর কাসিম তাঁকে পদচুৃ্যত করেন। কিন্তু ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা তাঁকে নায়েব নাজিম পদে পুনর্বহাল করে।

পলাশী পরবর্তী নায়েব নাজিমবৃন্দ  পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা নায়েব নাজিমের পদ বিলোপ করে নি, বরং তারা তাদের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদেরই সে পদে নিয়োগ করেছিলেন। ক্রমে এ পদ তার আগেকার ক্ষমতা ও গৌরব হারিয়ে ফেলে এবং শুধু নামে টিকে থাকে। তাদের ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ পদ বজায় রেখেছিল। ১৭৬৩ সালে মীরজাফর দ্বিতীয়বারের মতো নওয়াব হলে মুহম্মদ আলীর স্থলে মুহম্মদ রেজা খান জাহাঙ্গীরনগরের নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। দীউয়ানি লাভের পর কোম্পানি রেজা খানকে মুর্শিদাবাদের নায়েব নাজিম নিযুক্ত করে এবং জসরত খানকে ঢাকার নায়েব নাজিমরূপে পুনর্বহাল করে।

১৭৬৫ সালে নায়েব নাজিমের প্রশাসনিক এলাকা ছিল মোটামুটিভাবে বর্তমান বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চল। জসরত খান ১৭৭৮ সাল পর্যন্ত তাঁর পদে বহাল ছিলেন এবং তাঁর পৌত্র হাশমত জঙ্গ (১৭৭৮-১৭৮৫) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। হাশমত জঙ্গের উত্তরাধিকারী ছিলেন নুসরত জঙ্গ (১৭৮৫-১৮২২)। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও উত্তরাধিকারী শামসুদ্দৌলা (১৮২২-১৮৩১) নওয়াব উপাধি ব্যবহার করেন। কমরুদ্দৌলা (১৮৩১-১৮৩৪) শামসুদ্দৌলার স্থলাভিষিক্ত হন এবং কমরুদ্দৌলার স্থলাভিষিক্ত হন  গাজীউদ্দীন হায়দার (১৮৩৪-১৮৪৩)। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা নিয়াবতের অবসান ঘটে।

১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসনের বিলোপ ঘটিয়ে বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। দীউয়ানি ও ফৌজদারি বিচারের জন্য কিছু সাধারণ প্রবিধান প্রণয়ন করা হয়। সব ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য প্রতি জেলায় একটি করে ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠার আদেশ দেওয়া হয়। এসব ফৌজদারি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নাজিম কর্তৃক নিযুক্ত বিচারকের অধীনে নিজামত সদর আদালতে আপিল করা যেত। কিছু কিছু পরিবর্তনসহ এ ব্যবস্থা ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হেস্টিংস নায়েব নাজিম ও নায়েব দীউয়ানের পদ থেকে রেজা খানকে বরখাস্ত করেন। রেজা খান অবশ্য ১৭৭৫ ও ১৭৭৯ সালে দুবার নায়েব নাজিম পদে পুনর্বহাল হন। লর্ড কর্নওয়ালিস এর আগমনের পর এ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। ১৭৮৭ সালে প্রণীত আইনে কালেক্টরকে ম্যাজিস্ট্রেটের এবং বিচারকেরও ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফৌজদারি আদালতের কাজীরা (দারোগা রূপেও পরিচিত) ছিলেন নায়েব নাজিমের অধীন। তারা সব অপরাধেরই বিচার করতেন এবং গুরুতর মামলাগুলি বিচারের জন্য নাজিমের কাছে পাঠাতেন। ১৭৯০ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস নায়েব নাজিমের পদ বিলোপ করেন।

১৭৬৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার নায়েব নাজিমের রাজস্ব ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল। পরবর্তী সময়ে তার কাজ ছিল শুধু তাঁর অধীনে ন্যস্ত জেলাগুলির প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করা। তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের শাস্তিদান, মুসলিম আইন অনুসারে বিচার করা, কামারদের গাদাবন্দুক বানানো থেকে বিরত রাখা, দুষ্কৃতকারীদের নিকট যুদ্ধের কাঁচামাল সীসা সরবরাহের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, রাজস্ব আদায়ে সচেষ্ট হওয়া, সময়মত কোষাগারে রাজস্ব জমা দেওয়া এবং যুদ্ধ সরঞ্জাম ও সরকারি নৌ-যানগুলি কার্যকর অবস্থায় রাখা। ঢাকার নায়েব নাজিমের প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট প্রভৃতি জেলার রাজস্ব তাঁকে বরাদ্দ করা হতো। নৌবাহিনী ও রণতরীগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঢাকায় বিশাল নওয়ারা ভূ-সম্পত্তি ছিল। নওয়ারা ভূমি অবশ্য ক্রমশ বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয় এবং ১৮২২ সালে নায়েব নাজিম নুসরত জঙ্গের মৃত্যুর পর নায়েব নাজিমের নওয়ারা মহল বাজেয়াপ্ত করা হয়।

পরবর্তীকালের ঢাকার নায়েব নাজিমরা কিছুটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও জীবনাচার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁরা এমন এক সময়ে ইংরেজি শেখেন ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন যখন পূর্ব বাংলার মুসলিম জনমত ওহাবী ও ফারায়েজীদের মতো সংস্কারবাদীদের ইসলামি ধর্মীয় উদ্দীপনা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। নায়েব নাজিম নুসরত জঙ্গের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি মনোভাব উল্লেখ করতে গিয়ে চালর্স ডয়লী বলেছেন যে, তাঁর দরবার কক্ষ ইংলন্ডের মুদ্রিত ছবি ও চিত্রকর্মে ভরপুর ছিল। নুসরত জঙ্গ ছিলেন ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে সুপন্ডিত ব্যক্তি এবং তিনি ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন।

১৮৩১ সালে নবাব শামসুদ্দৌলার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কমরুদ্দৌলা (১৮৩১-১৮৩৪) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। কমরুদ্দৌলার পুত্র ও উত্তরাধিকারী গাজীউদ্দীন হায়দার ‘পাগলা নওয়াব’ রূপে পরিচিত ছিলেন। তিনি কোন উত্তরাধিকারী না রেখে ১৮৪৩ সালে মারা যান। তিনি নিদারুণ অর্থাভাব ও কষ্টে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি এত অমিতব্যয়ী ছিলেন যে, সরকারকে তাঁর জমিদারি একজন প্রতিনিধির হাতে তুলে দিতে হয়েছিল। তিনি উত্তরাধিকারীহীনভাবে মারা গেলে নায়েব নাজিম পদটি বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করা হয়।

নায়েব নাজিমরা সাধারণ্যে নওয়াবরূপে আখ্যায়িত হতেন। তাঁদের আমলে বণিকদের কর্মতৎপরতা দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রপ্তানি প্রায় তিন থেকে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঢাকার ক্রমোন্নতি বাধাগ্রস্ত হলেও তা বন্ধ হয়ে যায় নি। নিয়াবত আমলের পঞ্চাশ বছরে স্থাপত্যশিল্পে তেমন কর্মতৎপরতা দেখা যায় নি। নায়েব নাজিমরা ইসলাম খানের কিলা বা দুর্গে বাস করতেন। কোম্পানির দীউয়ানি লাভের পর কোম্পানির কর্মচারীরা দুর্গটি দখল করে নেয় এবং নায়েব নাজিমরা বাসস্থান পরিবর্তন করে বড় কাটরা প্রাসাদে চলে যান। ১৭৬৬ সালে নিমতলী প্যালেস নির্মিত হলে নায়েব নাজিম জসরত খান ঐ প্রাসাদে উঠে আসেন। এ আমলের স্থাপত্য কর্মের মধ্যে নিমতলী প্যালেস ছাড়াও মির্জা লুৎফুল্লাহ কর্তৃক ১৭২৮ সালে নির্মিত চক মসজিদ এবং ১৭৩৫ সালে নির্মিত আরমানিটোলা মসজিদ এর উল্লেখ করা যেতে পারে।  [কে.এম করিম]