নকশি পাখা

নকশি পাখা  নকশাযুক্ত হাতপাখা এবং লোকশিল্পের অন্যতম উপকরণ।  হাতপাখার ব্যবহার বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত, এমনকি এখনও এর বহুল প্রচলন রয়েছে। এ হাতপাখাকে আকর্ষণীয় করার জন্য একে যখন নয়নরঞ্জক নানা নকশায় শোভিত করা হয়, তখনই একে বলা হয় নকশি পাখা।

নকশি পাখা

নকশি পাখার উপকরণ প্রধানত সুতা,  বাঁশ, বেত, খেজুরপাতা, শোলা, তালপাতা ও শণ। ময়ূরের পালকের পাখা ও চন্দন কাঠের পাখাও প্রচলিত আছে। ময়ূরের পালকের পাখায় বাড়তি কোনো নকশার দরকার হয় না। নকশি পাখা মূলত চিত্রজ্ঞাপক এবং এতে যে চিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয় তার ওপর ভিত্তি করেই এর নামকরণ করা হয়, যেমন: ভালোবাসা, কাঁকইর জালা, গুয়াপাতা, পালংপোষ, শুজনিফুল, বলদের চোখ, শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, ছিটাফুল, তারাফুল, মনবিলাসী, মনবাহার, বাঘবন্দী, ষোলকুড়ির ঘর, মনসুন্দরী, লেখা, সাগরদীঘি, হাতি-ফুল-মানুষ, গম্বুজ তোলা, পাশার দান, যুগলহাঁস, যুগল ময়ূর ইত্যাদি। যুগলহাঁস ও যুগল ময়ূরের উল্লেখ আছে কিশোরগঞ্জের একটি  মেয়েলী গীতএ। এতে বলা হয়েছে: ‘সেই পাংখাত লেইখা গো থইছে অাঁসাঅাঁসির জোড়া গো, সেইনা পাংখাত লেইখা গো থইছে মউরামউরীর জোড়া গো।’ বুটির বিন্যাসের ওপর ভিত্তি করে পাখায় মোটিফ তোলা হয় এবং বুটির আকার (জ্যামিতিক বৃত্ত, আয়তাকার, এিভুজ বা ঝালর) ও সংখ্যা অনুযায়ী বিভিন্ন পাখা বিভিন্ন চিত্রমাত্রা গ্রহণ করে।

নকশার জন্য পাখার উপকরণগুলি বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে নেওয়া হয়।  নকশি কাঁথায় যেমন ফোঁড় ব্যবহূত হয়, নকশি পাখায় তেমনি চেলা ব্যবহার করা হয়। পাখায় রঙের ব্যবহার শিল্পীর নিজস্ব অনুভূতির ওপর নির্ভর করে। সুতার পাখার মূল বৈশিষ্ট্য এ যে, এতে বুননের মাধ্যমে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। সাধারণত বাঁশের হাতলের সঙ্গে বাঁশের গোল চাক বা চটি সংযুক্ত করা কয় এবং চাকে শাড়ির পাড়ের সুতার সাহায্যে টান টান করে পর্দা দেওয়া হয়। এ সুতার ভিতর দিয়ে সুচের সাহায্যে অন্য রঙের সুতা দিয়ে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা তোলা হয়ে থাকে। অনেক সময় এ ধরনের পাখায় বুননের মাধ্যমে বিভিন্ন  ছড়া ও  প্রবাদ ফুটিয়ে তোলা হয়, যেমন: ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে’, ‘দিন যায় কথা থাকে, সময় যায় ফাঁকে ফাঁকে’ ইত্যাদি।

অনেক সময় বাঁশের গোল চাকতিতে সাদা কাপড় মুড়ে তাতে সূচিকর্মের মাধ্যমে নানান ধরনের ফুল ও লতাপাতা চিত্রিত করা হয়। এ ধরনের পাখায় চতুর্দিকে থাকে লালসালুর ঝালর। এ পাখা গ্রামাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের সুতার তৈরি নকশি পাখা বেশ আকর্ষণীয়। বাঁশ বা বেতের তৈরি পাখার বুনন পদ্ধতি অনেকটা পাটি বোনার মতো এবং এর আকৃতি হয় গোলাকার বা চারকোণাবিশিষ্ট। বাঁশের ফালি থেকে সরু বেতি তুলে নিয়ে বুননের মাধ্যমে নকশা তোলা হয়। অনেক সময় বাঁশের বেতিতে বিভিন্ন রং লাগিয়ে বুননের মাধ্যমে চারকোণা, তিনকোণা ইত্যাদি নকশা তৈরি হয়।

গ্রামবাংলার জনপ্রিয় পাখা হচ্ছে তালপাতার পাখা। একটি তালপাতা থেকে একটি মাত্র পাখা তৈরি হয়। পাকা তালপাতা গোল করে কেটে তার চতুর্দিকে বাঁশের সরু চটি দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর সরু বেতি দিয়ে ছোট ছোট তিনকোণা নকশা তোলা হয়। এছাড়া তালপাতা সরু করে কেটে বুননের সাহায্যে নকশি পাখা তৈরি করা হয়। এ ধরনের পাখা নাটোরে বেশ জনপ্রিয়।

বর্তমানে বিভিন্ন লোকমেলায় শোলার তৈরি এক ধরনের পাখা পাওয়া যায়। এ পাখা অত্যন্ত হালকা। শোলা পাতলা করে কেটে একটি কাগজের পাতলা বোর্ডের উপর আঠা দিয়ে লাগিয়ে এ পাখা তৈরি করা হয়। শোলার তৈরি পাখায় অনেক সময় রঙের সাহায্যে নানা ধরনের নকশাও ফুটিয়ে তোলা হয়। বিশেষ করে পালা-পার্বণ বা মেলায় এ ধরনের পাখা দেখা যায়।

চন্দন কাঠের পাখা এদেশীয় না হলেও এদেশের বিত্তবান পরিবারের মেয়েরা আঠারো-উনিশ শতকে তা ব্যবহার করত। বর্তমানেও এর ব্যবহার আছে। চন্দন কাঠের ফোল্ডিং পাখার অনুকরণে এ দেশে এখন তালপাতার ফোল্ডিং পাখা তৈরি হচ্ছে। এ পাখা সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় এর ব্যবহারও বেশি। যুগের চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিকের পাখা। এসব পাখায় নকশার বৈচিত্র্য না থাকলেও রঙের ব্যবহার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বৈদ্যুতিক পাখার প্রচলন হওয়ায় বাংলার এ জনপ্রিয় লোকশিল্প ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।  [জিনাত মাহরুখ বানু]