নকশি কাঁথা

নকশি কাঁথা নকশা করা কাঁথা, বাংলার অন্যতম লোকশিল্প। বাংলাদেশে এ পারিভাষিক শব্দটির বহুল ব্যবহার শুরু হয় জসীমউদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯)  কাব্য থেকে। পশ্চিমবঙ্গে নকশা করা হোক বা না-হোক সকল কাঁথাই ‘কাঁথা’ নামে পরিচিত ছিল। ইদানীং অবশ্য ‘নকশি কাঁথা’ শব্দের প্রচলন হয়েছে। কাঁথাকে খেতা, কেন্থা ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।

কাঁথা তৈরি হয় সাধারণত পুরনো কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি ও ধুতি দিয়ে। সাধারণ কাঁথা বছরের সব সময়ই ব্যবহূত হতে পারে, কিন্তু নকশি কাঁথা বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহূত হয় এবং তা পুরুষানুক্রমে স্মারক চিহ্ন হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের কাঁথাকে বলে শুজনি। প্রয়োজনীয় পুরুত্ব অনুযায়ী তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরীভূত করে সাধারণ ফোঁড়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং সেলাইগুলি দেখতে ছোট ছোট তরঙ্গের মতো। সাধারণত শাড়ির রঙিন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে শাড়ির পাড়েরই অনুকরণে নকশা তৈরি করা হয়। তবে কাপড় বোনায় ব্যবহূত সুতাও কাঁথার নকশা তৈরিতে ব্যবহূত হয়, বিশেষত রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে।

নকশি কাঁথা

কাঁথা সাধারণত বিছানা হিসেবে এবং অল্প শীতে হালকা চাদর হিসেবে ব্যবহূত হয়। ছোট কাঁথা শিশুকে পেঁচিয়ে রাখার কাজেও ব্যবহূত হয়। আকার ও ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে কাঁথার বিভিন্ন নাম হয়। লেপ-কাঁথা ও শুজনি-কাঁথা আকারে বড় এবং লেপ-কাঁথা হয় মোটা, আর শুজনি-কাঁথা হয় পাতলা। এক বর্গফুট আকারের কাঁথার নাম রুমাল-কাঁথা। এ ছাড়া আরও আছে আসন-কাঁথা– বসার কাজে ব্যবহূত হয়; বস্তানি বা গাত্রি– কাপড়-চোপড় বা অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ঢেকে রাখা হয়; আর্শিলতা– আয়না, চিরুনি, কাজলদান ইত্যাদি ঢেকে রাখার কাজে ব্যবহূত হয়; দস্তরখান– খাবারের সময় মেঝেতে পেতে তার উপর খাদ্যদ্রব্য ও বাসন-কোসন রাখা হয়; গিলাফ– খাম আকৃতির এ কাঁথার মধ্যে কুরআন শরিফ রাখা হয় এবং জায়নামাজ– যার উপর বসে নামায পড়া হয়।

সাধারণ কাঁথা কয়েক পাল্লা কাপড় দিয়ে কাঁথাফোঁড়ে সেলাই করা হয়। উনিশ শতকের কিছু পুরনো কাঁথায় উজ্জ্বল চিত্রযুক্ত নকশা দেখা যায়, যা কাঁথাফোঁড়ে চমৎকার উদ্ভাবনী কুশলতায় তৈরি করা হয়েছে। কাঁথাফোঁড়ের নৈপুণ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে তৈরি হয়েছে হালকা তরঙ্গ, রঙের ভুবন, বিচিত্র বর্ণের বিন্দুনকশা ও বয়নভঙ্গি, যা দেখতে মনে হয় হাতে সেলাই করা নয়, তাঁতে বোনা।

কাঁথাফোঁড়ের আবার বৈচিত্র্য আছে এবং সে অনুযায়ী এর দুটি নাম হয়েছে: চাটাই বা পাটি ফোঁড় এবং কাইত্যা ফোঁড়। নকশার সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য ফোঁড়ের দৈর্ঘ্য কখনও কখনও বড়-ছোট হয় এবং তখন তাকে তাঁতে বোনা শাড়ির পাড়ের অবিকল নকল বলে মনে হয়। কাঁথা হচ্ছে মিতব্যয়িতার একটি দৃষ্টান্ত, কারণ এ ক্ষেত্রে পুরনো কাপড় একত্র করে নতুন কিছু একটা তৈরি করা হয়। তাছাড়া পুরনো কাপড়ের একটা অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হয়- তা হলো কারও কুদৃষ্টি প্রতিহত করা। কাঁথা মোটিফগুলির মধ্য দিয়ে শিল্পিমনের বিভিন্ন আবেগ ও অনুভূতি প্রতিফলিত হয়। কাঁথায় যে পৌনঃপুনিক মোটিফগুলি দেখা যায় তার অনেকগুলি বিভিন্ন উৎসব ও ব্রত উপলক্ষে অঙ্কিত  আলপনা শিল্পেও ব্যবহূত হয়। এ মোটিফগুলি সূচিশিল্পীর সুখ, সমৃদ্ধি,  বিবাহ এবং মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে।

বৈচিত্র্য থাকলেও অধিকাংশ কাঁথায়ই মোটিফের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি অনুসৃত হতে দেখা যায় এবং সেটি হলো কাঁথার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি পদ্ম মোটিফ। এর চারদিকে থাকে এককেন্দ্রিক কতগুলি বৃত্ত, যা দেখতে তরঙ্গায়িত লতা বা শাড়ির পাড়ের মতো। কাঁথার চার কোণায় কিংবা পদ্মের চতুর্দিকে বর্গাকৃতির যে নকশা থাকে তার চার কোণায় গাছের মোটিফ বা কল্কার নকশা করা হয় এবং সেগুলি কেন্দ্রীয় মোটিফের দিকে মুখ করা থাকে। কেন্দ্রীয় এবং কৌণিক মোটিফের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাগুলি প্রকৃতি ও খামার বাড়ি কিংবা বাস্তব জীবন অথবা লোককাহিনীর দৃশ্যমূলক মোটিফদ্বারা পূর্ণ করা হয়। কাঁথায় ব্যবহূত পুষ্প মোটিফ ছাড়াও আবর্তক মোটিফগুলি হচ্ছে: স্বস্তিকা, কুলো,  অলঙ্কার, হাতি, বাঘ, ঘোড়া, ময়ূর, নৌকা, জগন্নাথদেবের রথ, নৃত্য, শিকার,  নৌকা বাইচ, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি হিন্দু দেবতা এবং হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্য। মোটিফ এবং দৃশ্যবিহীন জায়গাগুলি তরঙ্গায়িত কাঁথাফোঁড়ে সেলাই করা হয়।

অন্য দুই প্রকার কাঁথা হলো: পাড়তোলা কাঁথা– এর সমস্তটাই শাড়ির পাড়ের ঢঙে নকশা করা হয় এবং লহরি বা লোহিরা কাঁথা– এতে মোটা সুতায় ঘন কারুকাজ করা হয়। পাড়তোলা কাঁথার ঘন কারুকাজের ক্ষেত্রে পাড় ও নকশার মধ্যে কোনো ফাঁক থাকে না, তাই পুরো কাঁথাটাকেই তাঁতে বোনা কাপড়ের মতো মনে হয়। অধিকাংশ কাঁথাই অশিক্ষিত মহিলাদের হাতে তৈরি, তবে কোনো কোনোটিতে বাংলা অক্ষরে অনেক প্রবাদ, আশীর্বাদ, এমনকি কোনো কোনো মোটিফ ও দৃশ্যের শিরোনামও লেখা হয় সেলাইয়ের মাধ্যমে। একটি কাঁথায় দেখা গেছে শিল্পী তাঁর জামাতাকে আশীর্বাদ করছেন: ‘সুখে থাকো’। কোনো কোনো কাঁথায় শিল্পীর স্বাক্ষর থাকে, যা তার এবং যার জন্য এটি তৈরি হয়েছে তার মধ্যেকার সম্পর্ককে নির্দেশ করে। কোনো কোনো কাঁথায় গ্রহীতার নামও দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরপুকুরের গুরুসদয় জাদুঘরে এরূপ একটি কাঁথায় লেখা আছে, জনৈকা মানদাসুন্দরী তাঁর পিতার জন্য নিজ হাতে কাঁথাটি তৈরি করেছেন। ফরিদপুরের একটি কাঁথায় কৃষ্ণকাহিনীর একটি দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাতে গাছের উপরে বসা কয়েকজন নগ্ন মহিলার একটি দৃশ্যের নীচে শিরোনাম লিখিত হয়েছে: বস্ত্রহরণ। ব্যবহারিক কাঁথা তৈরি কখনও বন্ধ না হলেও বিশ শতকের প্রথম দশকগুলিতে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, মেশিনে তৈরি জিনিসপত্রের প্রাচুর্য এবং রুচির পরিবর্তন এক সময়ের শিল্পসমৃদ্ধ এ নকশি কাঁথাকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যায়। তবে বর্তমান বছরগুলিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নৃতাত্ত্বিক শিল্পকলার প্রতি মানুষের আগ্রহ কাঁথাশিল্পের পুনরুজ্জীবনে উৎসাহের সৃষ্টি করেছে।  [নিয়াজ জামান]