দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি আঠারো শতকে নির্মিত দিঘাপতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান। দয়ারাম রায় (১৬৮০-১৭৬০) এ রাজবংশের  প্রতিষ্ঠিাতা। বর্তমানে এটি ব্যবহূত হয় উত্তরা গণভবন বা উত্তরাঞ্চলের গভর্নমেন্ট হাউস হিসেবে। নাটোর শহর থেকে প্রায় ২.৪ কিমি দূরে প্রাসাদটি অবস্থিত। নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক থেকে একটি সংযোগসড়কের মাধ্যমে প্রাসাদটিতে যাওয়া যায়।

দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া প্রাসাদের মূল অংশ ও এর সংলগ্ন আরও কিছু ভবন নির্মাণ করেন। কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে প্রাসাদটি ধ্বংস হলে প্রমোদনাথ রায় সম্পূর্ণ প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি পুনঃনির্মাণ করেন।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি, নাটোর (বর্তমানে উত্তরা গণভবন)

৪৩ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদ এলাকাটি একটি পরিখা ও উচু প্রাচীরবেষ্টিত। এর পূর্ব পার্শ্বে রয়েছে একটি চারতলাবিশিষ্ট পিরামিডাকৃতির প্রবেশ দ্বার। এটি উপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে একটি ঘড়িবিশিষ্ট টাওয়ারে শেষ হয়েছে। এটি আরও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে তিন তলার সারিবদ্ধ খিলানপথ ও সর্বোচ্চ তলার ঘড়ির পাশে দুটি বৃত্তাকার চক্রের উপস্থিতিতে। এক তলা পূর্বমুখী প্রধান প্রাসাদ ব্লকটি ৩০.৪৮ মিটার দীর্ঘ ফাসাদে সমৃদ্ধ। ইংরেজি ‘ই’ অক্ষরের আদলে নির্মিত প্রাসাদটির সম্মুখভাগে রয়েছে সামনের দিকে অভিক্ষিপ্ত তিনটি বারান্দা যার মাঝেরটি দু’প্রান্তের দুটি অপেক্ষা বেশ লক্ষণীয়ভাবেই অভিক্ষিপ্ত। ফাসাদের সমস্তটাই প্লাস্টারের মাধ্যমে অঙ্কিত ফুলনকশায় শোভিত। এক সারি ত্রি-খাজ বিশিষ্ট সূচ্যগ্র খিলানপথ প্রাসাদের সামনের অংশের লম্বা ব্যালকনি পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশের পথ করে দিয়েছে। উপরে ছাদের প্যারাপেটটি মেরলোন নকশায় অলংকৃত। প্রাসাদ কেন্দ্রের মূল হলঘরটির উপরে নির্মিত গোলাকার গম্বুজটি তার সমাপ্তি টেনেছে তীক্ষ্ম শীর্ষে। কলসচূড়া বিশিষ্ট গোলাকার গম্বুজ দ্বারা প্রাসাদের কেন্দ্রীয় মূলকক্ষটি আবৃত। প্রধান প্রবেশ পথের সিড়ির দুপ্রান্তে রয়েছে প্রমাণ সাইজের ঢালাই লোহায় নির্মিত নব্য-ক্লাসিক্যাল গ্রিক রীতির অসাধারণ দুটি নারী ভাস্কর্য। এদের প্রত্যেকটির মাথার উপর রয়েছে একটি করে বাতিদানি।

প্রাসাদের এ ব্লকটিতে রয়েছে নয়টি শয়নকক্ষ, একটি অভ্যর্থনা হল, একটি ডাইনিং হল ও একটি সম্মেলন কক্ষ। ৭.৬২ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট অভ্যর্থনা হলের ছাদটি পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশ উঁচু। এর সিলিংটি পাশাপাশি কাঠের ফ্রেমের মাঝে আটকানো ফুলেল নকশা দ্বারা দৃষ্টিনন্দনভাবে সজ্জিত। প্রাসাদের বিভিন্ন মূল্যবান দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হয়ে গেলেও এখনও অবশিষ্ট বিভিন্ন জিনিসের মাঝে রয়েছে নব্য-ক্লাসিক্যাল গ্রিক ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, ফুলদানি, ঝাড়বাতি, খোদাইকৃত কাঠেরপালঙ্ক ও আসবাবপত্র।

প্রাসাদের দক্ষিণ ব্লকটিও একই রকম ইংরেজি ‘ই’ অক্ষরের আদলে পরিকল্পিত। এর সামনে রয়েছে ঝর্না সমৃদ্ধ একটি আকর্ষণীয় বাগান।

চার কোণের ফাঁকা চত্বরে রয়েছে প্রমাণ সাইজের মার্বেলের নারী ভাস্কর্য। ব্লকের সামনের একটি প্রশস্ত বারান্দা উন্মুক্ত হয়েছে প্রধান হল রুমে এবং এর পরে রয়েছে সারি সারি কক্ষ। বারান্দার ছাদটি ত্রিখাঁজ আকৃতির খিলানে রূপান্তরিত সেমি-কোরিনথিয়ান স্টাইলের স্তম্ভের উপর ন্যস্ত। ব্লকটির পশ্চিম প্রান্তে পেছনের একটি সর্পিল অাঁকাবাঁকা বারান্দা থেকে পরিখাটির একাংশ দৃশ্যমান।

প্রধান প্রাসাদ ব্লকটির নিকটবর্তী দক্ষিণাংশের ‘কুমার প্যালেস’টি একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন। এর উপরের তলায় রয়েছে চারটি শয়নকক্ষ ও একটি ড্রেসিং রুম এবং নিচে রয়েছে কক্ষের সারি। খাজাঞ্চিখানার ছোট ভবনটি কুমার প্যালেসের পেছনেই অবস্থিত। একতলার ম্যানেজার অফিসটি উত্তর দিকের প্রবেশপথের নিকটেই অবস্থিত। প্রধান ব্লকের দক্ষিণে অবস্থিত একতলা রানীমহলের মতো অন্যান্য আরও কিছু ভবন দুর্গপ্রাচীরের বেষ্টনীর মধ্যে প্রাসাদ এলাকার বিশাল মূল অংশ জুড়ে বিদ্যমান ছিল। অতিথি ভবন, আস্তাবল, কর্মচারীদের কোয়ার্টার ইত্যাদি সবকিছুই সময়ের সাথে সাথে এবং ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে।  [নাজিমউদ্দীন আহমেদ]

গ্রন্থপঞ্জি  কালীনাথ চৌধুরী, রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কলকাতা, ১৩০৮; 'Bangladesh District Gazetteer', Rajshahi, 1976; Nazimuddin Ahmed, Buildings of the British Raj in Bangladesh, Dhaka, 1986; Md. Mahbubur Rahman, Varendrer Raja O Jamidar in Varendra Avchaler Itihasa, Chaitra, 1404 BS.