দার্জিলিং

দার্জিলিং  ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর-পূর্বে একটি নগর, পর্যটন কেন্দ্র ও কয়লা খলি কেন্দ্র। নেপাল, সিকিম, ভুটান ও তিববত বেষ্টিত দার্জিলিংকে ব্রিটিশরা ১৮১৪ সালে অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৮১৫ সালের সাগাউলি (Sagauli) চুক্তির আওতায় নেপালের নিকট থেকে দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা দার্জিলিংকে একটি সরকারি আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেছে নেয় যাতে তারা সেখানে স্থান পরিবর্তনে গিয়ে নিজ দেশের জলবায়ু ও পরিবেশ পায়। সময়ের পরিক্রমায় তারা যে সমস্ত পাহাড়ি আবাসভূমি গড়ে তোলে (সিমলা, কোদাইকানাল, মুসুরী, মহাবানেশ্বর, মাউন্ট আবু, নৈনিতাল, রানীক্ষেত, শিলং প্রভৃতি) তার মধ্যে দার্জিলিং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাণী ও গাছপালা এবং তাপমাত্রার দিক থেকে সবচেয়ে নয়নাভিরাম।

সমুদ্র তল থেকে ২২৮৬ মিটার উঁচুতে অবস্থিত দার্জিলিং-এ ১৮১৫ সালে প্রকৃতপক্ষে কোনো স্থায়ী বসতি ছিল না। কিন্তু ১৯ শতকের শেষে এটি ১৫ হাজার বসতির একটি শহরে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া ১৮৯০ সাল থেকে সেখানে বছরে এক লাখেরও বেশি পর্যটক ভ্রমণ করতে থাকে। বর্তমানে দার্জিলিং-এর আয়তন পাহাড়ি শহর হিসেবে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সারা বিশ্বে দার্জিলিংয়ের প্রচুর সুখ্যাতি রয়েছে। ১৮৯৮ সাল থেকে দার্জিলিং বঙ্গ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। পর্যটন ও স্বাস্থ্য উদ্ধার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি ছাড়াও দার্জিলিং অপূর্ব সুগন্ধযুক্ত চা ও শাসক শ্রেণির ছেলেমেয়েদের বিশেষ শিক্ষার স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়।

১৮৩৮ সালে আধুনিক দার্জিলিং-এর যাত্রা শুরু হয়। এসময় এ এলাকায় রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য পাহাড়ি জনগণের সমন্বয়ে একটি আধা-সামরিক শ্রমিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্য লেফটেন্যান্ট গ্লিমোরকে নির্বাহী প্রকৌশলি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একাজে গ্লিমোর ততটা সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। প্রকৌশল শাখার লেফটেন্যান্ট রবার্ট নেপিয়ার (পরবর্তী ফিল্ড মার্শাল লর্ড নেপিয়ার) তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি অতি সাহসিকতার সঙ্গে এ দুঃসাহসিক কাজ হাতে নেন এবং একটি পাথরের রাস্তা তৈরি করে দার্জিলিং-এর সঙ্গে শিলিগুড়ির সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেন। এ রাস্তাটি এখনও বিদ্যমান। পরবর্তীকালে এ রাস্তা বরাবর একটি ন্যারো গেজ ট্রামপথ বসানো হয়। দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ের প্রথম ব্যবস্থাপক স্যার ফ্রাঙ্কলিন প্রেজটেজ এ বিশাল কাজের নেতৃত্ব দেন। ১৮৮১ সালে এ ট্রামপথের কাজ শেষ হয়। সেই থেকে, দার্জিলিং শুধু সহজে প্রবেশযোগ্যই হয়নি বরং রেলপথ প্রবর্তনের মাধ্যমে একে কার্যকরভাবে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা গেছে।

প্রশাসনিকভাবে রাজশাহী বিভাগের দিনাজপুর জেলার অধীনে দার্জিলিং একটি পাহাড়ি শহর হিসেবে সমৃদ্ধি লাভ করে। ১৮৯৮ সালে এখানে বাংলা সরকারের গ্রীষ্মকালীন সচিবালয় স্থাপন করা হলে দার্জিলিং একটি অনন্য রাজনৈতিক মর্যাদা পায়। এখানে বেশ কিছু কনভেন্ট ও সরকারি স্কুল স্থাপন করা হয়। এসব বিদ্যালয়ে ইউরোপীয় ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং স্থানীয় অভিজাত পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করত। ক্যাম্ব্রিজ জুনিয়র স্কুল ও উচ্চ বিদ্যালয় সার্টিফিকেট পরীক্ষার প্রস্ত্ততিমূলক পড়াশোনা এসব বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত স্কুলগুলি হচ্ছে লোরেটো কনভেন্ট, সেন্টপল্স এবং সেন্ট জোসেফ কলেজ। এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে তাদের গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে দার্জিলিং তার পর্যটন ও চা-এর জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত।  [সিরাজুল ইসলাম]