দাদনি প্রথা

দাদনি প্রথা  দাদনি শব্দটি ফার্সি দাদন (আগাম) শব্দ থেকে উদ্ভূত। কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যবসায়িক চুক্তির স্মারক হিসেবে কোনো আগাম দিলে তাকে দাদনদার বলা হয়। আঠারো শতকে বাংলায় ইংরেজ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা-ব্যবস্থাপনায় দাদনি কথাটি একটি বাণিজ্যিক বুলি হিসেবে ব্যবহূত হতো। ভাষা ও অন্যান্য আয়োজক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে কোম্পানি বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিযুক্ত করত তাদের দাদনি ব্যবসায়ী বলা হতো। তারা কিছু নির্ধারিত শর্তে পণ্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতিতে কোম্পানির কাছ থেকে আগাম অর্থ গ্রহণ করত। স্থানীয় বাজারে গিয়ে নির্ধারিত সময় ও বর্ণনা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহের শর্তে প্রকৃত উৎপাদককে আগাম হস্তান্তর করার জন্যই তাদের এ অর্থ প্রদান করা হতো। দাদনি ব্যবসায়ীরা সরাসরি প্রকৃত উৎপাদককে কিংবা দালাল বা পাইকার (স্থানীয়  আড়তদার) নামে অভিহিত দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ঐ দাদন হস্তান্তর করত। দাদন ব্যবসায়ী এ কাজটি করত একটি নির্ধারিত বাট্টা বা কমিশনের বিনিময়ে যার একটা অংশ অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী তথা দালালরাও পেত। বহু দাদনি ব্যবসায়ী যথাসময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হতো, এমনকি তাদের অনেকে আগাম দেওয়া কোম্পানির অর্থ নিয়ে গা-ঢাকা দিত। এসব কারণে ১৭৫৩ সালে দাদনি প্রথা রহিত করা হয়।

পরবর্তীকালে কোম্পানি তাদের নিজস্ব লোক (কুঠি প্রধান) ও গোমস্তা বা দেশি আমলার মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ পরিবর্তনেও প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায় নি। উৎপাদক শ্রেণি, বিশেষ করে, তাঁতিরা প্রায়শ গোমস্তা, পাইকার ও দালালদের নিপীড়নের শিকার হতো। এইসব গোমস্তা, পাইকার ও দালালের উপস্থিতি পণ্য উৎপাদকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করত বলে সমসাময়িক বিবরণে জানা যায়। এ পরিস্থিতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আবার পুরানো দাদনি পদ্ধতিতে ফিরে আসে। কিন্তু যেহেতু এ ব্যবস্থায় মফস্বল অঞ্চলে অবস্থানরত কোম্পানির কর্মচারীদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত লাগে, সে কারণে দাদনি ব্যবস্থাকে আগের মতো আর অবাধে চলতে দেওয়া হয় নি। কায়েমি স্বার্থবাদী মহলগুলির চাপে ১৭৭৫ সালে আবার গোমস্তা প্রথা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু আবারও বিপর্যয় ঘটে। এবারও  তাঁতি, লবণ শ্রমিক,  রেশম উৎপাদক, অন্যান্য পণ্যের উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা গোমস্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তোলে। কর্নওয়ালিস সরকার দেশিয় দালাল বা মধ্যস্থ বেনিয়া দাদনি ব্যবসায়ী ও গোমস্তার মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহের সনাতন পদ্ধতি পরিহার করে স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য নতুন গড়ে উঠা এজেন্সি হাউজকে এ কাজে নিয়োজিত করে।  [সিরাজুল ইসলাম]