ডাক

ডাক  প্রাচীন বাংলার একজন বচনকার বলে কথিত। ‘ডাক’ অর্থে মন্ত্রসিদ্ধ বা তন্ত্রশাস্ত্রে অভিজ্ঞ কোনো পুরুষকেও বোঝায়; আর ‘ডাকিনী’ বলতে বোঝায় মন্ত্রসিদ্ধা স্ত্রীলোককে। বৌদ্ধ তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত ডাকিনী শক্তিদেবীর অন্যতম সহচরী। তবে তাঁর সঙ্গে অপদেবতার একটা সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনায় ‘বজ্রডাকিনী’র ভূমিকার ওপর কিছুটা গুরুত্বও দেওয়া হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ‘ডাক’ ও ‘ডাকিনী’ অর্থে যথাক্রমে তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ কোনো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীকেও বোঝায়। তবে সাহিত্যে ডাকের ভূয়োদর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে পন্ডিত ও গবেষকগণ মনে করেন, ডাক যদি ব্যক্তিবিশেষ কেউ হন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো গুণী ব্যক্তি।  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভবের প্রাক্কালে ডাকার্ণব নামে একটি বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এটিকেই ডাকের বচনের প্রামাণিক গ্রন্থরূপে গণ্য করা হয়।  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের পুথিশালা থেকে গ্রন্থটি উদ্ধার করেন।

প্রচলিত মতে ডাক ছিলেন একজন গোপ। অসমিয়া সাহিত্যে বুরুঞ্জি লেখক অভিমত ব্যক্ত করেন যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের কামরূপ জেলার বরপেটা মহকুমার অন্তর্গত লোহি ডাঙ্গরা নামক স্থানে ডাকের বসবাস ছিল। বাংলাদেশে প্রচলিত  ডাকের বচনের সাহিত্যিক অভিব্যক্তি থেকে ডাককে গোপসন্তান বলা হয়েছে, তবে অসমিয়া সাহিত্যে তিনি কুম্ভকাররূপে অভিহিত।

ভাব ও ভাষা বিচারে পন্ডিতগণ ডাকের বচনগুলিকে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত বলে মনে করেন। তবে বর্তমানে প্রাপ্ত অনেক বচনে এরূপ প্রাচীনত্ব পরিলক্ষিত হয় না। এর কারণ, লোকের মুখে মুখে বচনগুলির প্রচলন ছিল বলে যুগের প্রবাহে সেগুলির ভাষারও পরিবর্তন ঘটেছে। এ কারণে  অনেক বচনের ভাষাগত মৌলিকত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কোনো কোনো বচনের প্রচার সীমিত ছিল বলে সেগুলির প্রাচীনত্ব একেবারে লুপ্ত হয়নি, যেমন: ক. ‘বুদ্ধা বুঝিয়া এড়িব লুন্ড। আগলে হৈলে নিবারিব তুন্ড\’, খ. ‘ডাঙ্গা লিড়ান বন্ধন আলি। তাতে দিও নানা শালী’, গ. ‘ভাষা বোল পাতে লেখি। বাটাহুব বোল পড়ি সাথি\’ ইত্যাদি।

ডাকের বচনে বাংলাদেশের লোকাচার ও জীবনাচরণের চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটেছে। কোনো কোনো বচনে বাঙালির জীবনাচরণের বেশ কৌতূহলোদ্দীপক প্রকাশও লক্ষ করা যায়। এতে অনুমিত হয়, এসব বচনের রচয়িতাগণ এ দেশেরই লোক ছিলেন। একটি বচনে ঘর ও ঘরনি সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে: ‘ঘরে স্বামী বাইরে বইসে। চারিপাশে চাহে মুচকি হাসে\ হেন স্ত্রীয়ে যাহার বাস। তাহার কেন জীবনের আশ\’

জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে ডাকের উপদেশ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘ঋণ করেও ঘি খাও’ চার্বাকের এ নীতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে ডাক বলেন: ‘ভাল দ্রব্য যখন পাব। কালিকারে তুলিয়া না থোব\ দধি দুগ্ধ করিয়া ভোগ। ঔষধ দিয়া খন্ডাব রোগ\ বলে ডাক এ সংসার। আপনা মইলে কিসের আর\’ ডাকের এসব বচনের ভাব ও ভাষা বেশ সহজবোধ্য। উপদেশাত্মক হওয়ায় বচনগুলি লোকসমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সেগুলির ভাষা সর্বজনীন রূপ লাভ করে।  [আজহার ইসলাম]