টাঙ্গাইল জেলা

টাঙ্গাইল জেলা (ঢাকা বিভাগ)  আয়তন: ৩৪১৪.৩৫ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°০১´ থেকে ২৪°৪৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৪৪´ থেকে ৯০°১৮´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে জামালপুর জেলা, দক্ষিণে ঢাকা ও মানিকগঞ্জ জেলা, পূর্বে ময়মনসিংহ ও গাজীপুর জেলা, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলা। মধুপুরের বনভূমি, সখীপুর ও ঘাটাইলের টিলা উল্লেখযোগ্য।

জনসংখ্যা ৩৬০৫০৮৩; পুরুষ ১৭৫৭৩৭০, মহিলা ১৮৪৭৭১৩। মুসলিম ৩৩৪২৫৯৬, হিন্দু ২৪৬২৩৭, বৌদ্ধ ১০০, খ্রিস্টান ১৪১২৫ এবং অন্যান্য ২০২৫। এ উপজেলায় গারো, বংশী ও কোল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর  বসবাস রয়েছে।

জলাশয় যমুনা, ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশী, লৌহজং, তুরাগ নদী উল্লেখযোগ্য।

প্রশাসন টাঙ্গাইল মহকুমা গঠিত হয় ১৮৭০ সালে এবং মহকুমা জেলায় রূপান্তরিত হয় ১৯৬৯ সালে। জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে ঘাটাইল সর্ববৃহৎ (৪৫১.৩০ বর্গ কিমি) এবং এটি জেলার মোট আয়তনের ১৩.৩৫% এলাকা জুড়ে অবস্থিত। জেলার সবচেয়ে ছোট উপজেলা ধনবাড়ী (১৩৩.৭৫ বর্গ কিমি)।

জেলা
আয়তন (বর্গ কিমি) উপজেলা পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
শহর গ্রাম
৩৪১৪.৩৫ ১২ ১০৯ ১৮৮৪ ২৪৪৩ ৫৪৩৭৮৫ ৩০৬১২৯৮ ১০৫৬ ৪৬.৮
জেলার অন্যান্য তথ্য
উপজেলা নাম আয়তন (বর্গ কিমি) পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
কালিহাতি ২৯৫.৬০ ১৪ ২৪৮ ২৯৮ ৪১০২৯৩ ১৩৮৮ ৪২.৯
গোপালপুর ১৯৩.৩৭ ১১১ ১৫৮ ২৫২৩৩১ ১৩০৫ ৪৫.৭
ঘাটাইল ৪৫১.৩০ ১১ ২৯৪ ৪১১ ৪১৭৯৩৯ ৯২৬ ৪৪.০
টাঙ্গাইল সদর ৩৩৪.২৬ ১২ ২৪৯ ২৭৬ ৫২১১০৪ ১৫৫৯ ৫৩.১
দেলদুয়ার ১৮৪.৫৪ - ১২৪ ১৬৭ ২০৭২৭৮ ১১২৩ ৫১.৬
ধনবাড়ী ১৩৩.৭৫ ১০৩ ১৩২ ১৭৬০৬৮ ১৩১৬ ৪৪.০
নাগরপুর ২৬২.৭০ - ১২ ২১৭ ২৪৫ ২৮৮০৯২ ১০৯৭ ৪২.৭
বাসাইল ১৫৭.৭৭ - ৭২ ১০৭ ১৫৯৮৭০ ১০১৩ ৫০.৪
ভূয়াপুর ২২৫.০০ ৯৩ ১২৮ ১৮৯৯১৩ ৮৪৪ ৪৩.৮
মধুপুর ৩৬৬.৯২ ১১১ ১৮০ ২৯৬৭২৯ ৮০৯ ৪১.২
মির্জাপুর ৩৭৩.৮৮ ১৪ ২০২ ২১৯ ৪০৭৭৮১ ১০৯১ ৫৫.৫
সখীপুর ৪৩৫.১৯ ৬০ ১২২ ২৭৭৬৮৫ ৬৩৮ ৪১.১

সূত্র আদমশুমারি রিপোর্ট ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইলে তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর বাহিনীর নাম ছিল কাদেরিয়া বাহিনী। এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় কৃতিত্বের সাথে পাকবাহিনীর মোকাবিলা করে। ২৮ মার্চ ভূয়াপুর কলেজের শহীদ মিনারের পাদদেশে ‘ভূঞাপুর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩ এপ্রিল মির্জাপুর উপজেলার গোড়ান সাটিয়াচরায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এপ্রিল মাসে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী গোপালপুর থানা আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে এবং থানাটি জ্বালিয়ে দেয়। ১৯ এপ্রিল কালিহাতি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর লড়াইয়ে ১ জন মেজরসহ প্রায় ৩৫০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ মাসেই মধুপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১১ আগস্ট ভূয়াপুর উপজেলার সিরাজকান্দিতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর জাহাজ আক্রমণ করে বিপুল গোলাবারুদ দখল করে এবং জাহাজটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৬ অক্টোবর সখীপুর উপজেলার বল্লায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৭ নভেম্বর ভূয়াপুর উপজেলার ছাব্বিশা গ্রামে পাকসেনারা ৩২ জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং ৩৫০ টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ১০ ডিসেম্বর কালিহাতি উপজেলায় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর আক্রমণে ৩৭০ জন পাকসেনা নিহত, শতাধিক আহত ও প্রায় ৬০০ জন বন্দি হয়। ১৩ ডিসেম্বর নাগরপুর উপজেলার সারেংপুরে পাকবাহিনী একই পরিবারের ৭ জনকে হত্যা করে। ঘাটাইল উপজেলার মাটিকান্দি নামক স্থানে হাবিবুর রহমান বীর বিক্রমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র-গোলাবারুদ বোঝাই একটি পাকিস্তানি জাহাজ দখল করে। সংঘর্ষে ৩০ জন পাকসেনা নিহত হয়। টাঙ্গাইল জেলার ৪টি স্থানে (নাগরপুর, মির্জাপুর, গোপালপুর ও ভূয়াপুরে) গণকবর এবং ২টি স্থানে (মির্জাপুর ও গোপালপুর) বধ্যভুমির সন্ধান পাওয়া গেছে। জেলায় ৩টি (টাঙ্গাইল সদর, ভূয়াপুর ও বাসাইল), ২টি স্মৃতিস্তম্ভ (সখীপুর ও গোপালপুর) এবং ১টি স্মৃতিফলক (ঘাটাইল উপজেলার মাকরাই কুমার পাড়া) স্থাপিত হয়েছে।

শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার ৪৬.৮%; পুরুষ ৫০.০%, মহিলা ৪৩.৮%। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৭), করটিয়া সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (১৯২৬), মধুপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (১৯৭২), কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ (২০০১), কুমুদিনী সরকারি মহিলা কলেজ (১৯৪৩), মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ (১৯৬৫), নাগরপুর সরকারি কলেজ (১৯৬৬), মহেড়া পুলিশ ট্রেনিং স্কুল (১৯৭০), ভারতেশ্বরী হোমস্, জিবিজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (১৯৬৯), ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ (১৯৯১), সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৭০), বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৮০), বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৮২), টাঙ্গাইল শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯০৭), বিএস বিশ্বেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়  (১৯২৬), রোকেয়া ফাজিল মাদ্রাসা (১৯২৫)।

জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৫৭.২৮%, অকৃষি শ্রমিক ২.৮৭%,শিল্প ৩.৪২%, ব্যবসা ১৩.০৭%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ৩.৬৩%, নির্মাণ ১.২৩%, ধর্মীয় সেবা ০.১৯%, চাকরি ৭.৯৪%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ২.১২% এবং অন্যান্য ৮.২৫%।

পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী দৈনিক: মফস্বল (১৯৮৭), দেশকথা, মজলুমের কণ্ঠ (১৯৯৫), আজকের টেলিগ্রাম, লোককথা, নাগরিক কথা, প্রগতির আলো, বংশাই; সাপ্তাহিক: পূর্বাকাশ (১৯৯৪), জনতার কণ্ঠ (১৯৯২), ধনবাড়ী বার্তা, মধুপুর বার্তা, সামাল, গণবিপ্লব, মধুবাণী; পাক্ষিক: মধুবাণী; ত্রৈমাসিক: আদালত (১৯৮১)। অবলুপ্ত পত্র-পত্রিকা: সাপ্তাহিক: হিতকরী (১৮৯২), সমাচার (১৯৩৬), হককথা (১৯৩৬), বুলেটিন বাংলা খুৎবা, সত্যকথা, জনতা (১৯৫৪), টাঙ্গাইল হিতৈষী (১৮৯০), নবমিহির (১৮৯১), প্রবাহ (১৯১৪), দূরবিন (১৯৪৭), জয়বাংলা (১৯৭১), পূর্বাকাশ, লৌহজং, খামোশ, মৌ বাজার, বিদ্রোহী কণ্ঠ, প্রযুক্তি, মূল স্রোত, টাঙ্গাইল বার্তা সাহিত্য পত্রিকা বালার্ক (১৯৭০); পাক্ষিক: সংকেত (১৯৭৩), আহম্মদী, হিতকরী (১৮৯২), রায়ত (১৯৩৬); মাসিক: আখবার-এ-ইসলামীয়া (১৮৮৩), নবযুগ (১৮৯০), নববিধান (১৮৯০), প্রজাশক্তি ১৯৩১)।

লোকসংস্কৃতি এ জেলায় নবান্ন, পৌষ সংক্রান্তী, বারুনী, অষ্টমী, নৌকবাইচ উল্লেখযোগ্য লোকউৎসব। ধূয়া, জারি, সারি, রাখালী, বারোমাসী, পালাগান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতী, বিচার, ভারা বানার গান, ভূত ছাড়ানোর গান, বিয়ের গান, ঘাটুগান, কবিগান, বাউলগান প্রভৃৃতি লোকসঙ্গীত বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া এ জেলায় লাঠিবাড়ি, নৌকাবাইচ, কাবাডি, ভাড়া ভুঁডা, চঙ্গদৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, ঢোপবাড়ী, গামছাবাড়ী, টুংকী বাড়ী সহ নানা ধরনের লোকক্রীড়ার প্রচলন রয়েছে।

দর্শনীয় স্থান জাতীয় উদ্যান (মধুপুর), বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু (ভূয়াপুর, কালিহাতি), যমুনা রিসোর্ট (কালি হাতি), জমিদার বাড়ি ও হিঙ্গানগরের রাজবাড়ি (দেলদুয়ার)। [আরিফা ইসলাম]

আরও দেখুন সংশ্লিষ্ট উপজেলা।

তথ্যসূত্র  আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১ ও ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; টাঙ্গাইল জেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭, টাঙ্গাইল জেলার উপজেলাসমূহের সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।