জেনানা

জেনানা  পরিবারের পুরুষ সদস্যদের থেকে স্ত্রীলোকদের পৃথক রাখার একটি ব্যবস্থা। ফারসি শব্দ  ‘জান’ অর্থাৎ মহিলা থেকে জেনানা শব্দের উৎপত্তি। জেনানা মূলত একটি মুসলিম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এর আওতায় পরিবারের মহিলা সদস্য এবং অভ্যাগত বা অতিথি মহিলাদের জন্য পৃথক কামরা বা ঘর বরাদ্দ থাকে। জেনানা ব্যবস্থায় পরিবারের পুরুষ ও নারী সদস্যগণ দিবসে পরিবারিক আঙিনায় পৃথক অবস্থানে কাজ করেন এবং বিশ্রাম নেন। সামাজিকভাবে, পরিবারের মহিলা সদস্যদেরও জেনানা বলা হয়।

এটি শুধু সামাজিক ও ধর্মীয় কারণেই নয়, দৈনন্দিন কাজকর্মে শ্রম বিভাজনের জন্যও করা হয়। এ ব্যবস্থা অন্দরমহল বা অন্তঃপুর নামেও পরিচিত। জেনানা পর্দাপ্রথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। পরিবারের গন্ডিতে যাকে জেনানা বলা হয় সেটিই সমাজের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে পর্দা নামে পরিচিত।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলা মুসলিম শাসনাধীনে আসার পর জেনানা প্রথা বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সুলতানি ও মুগল আমলে শাসকশ্রেণি এবং আশরাফ ও খানদানী পরিবারসমূহ জেনানা ব্যবস্থা কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন। তাঁদের প্রভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবার ও স্থানীয় মুসলমানগণও জেনানা প্রথা গ্রহণ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পিউরিটান আন্দোলনের প্রভাবে ইংল্যান্ডেও জেনানা ব্যবস্থা বিস্তার লাভ করে। ব্যবস্থাটি জনপ্রিয় করতে ইংল্যান্ডে বেশ কয়েকটি জেনানা মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সেখানে জেনানা প্রথা কোনো স্থায়ী ভিত্তি লাভ করতে পারে নি। সেখানে পুরুষ ও মহিলাদের মেলামেশা অধিকতর জনপ্রিয় হওয়ার কারণে জেনানা অচিরেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক পর্যন্ত বাংলায় মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে জেনানা একটি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্ম আন্দোলন হিন্দুদের এ প্রথা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রথম সক্রিয় উদ্যোগ নেয়। ব্রাহ্ম মহিলারা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে একত্রে কর্মসম্পাদন ও খোলামেলাভাবে মেলামেশা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তাঁরা পর্দা ব্যতিরেকে গৃহের বাইরেও গমনাগমন শুরু করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকে আধুনিকত্ববাদ, নগরায়ন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, নারীর ক্ষমতায়ন এবং শহর এলাকার আবাসন ব্যবস্থা ও অন্যান্য কারণে জেনানা প্রথার বিলুপ্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তবে গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে যেখানে এখনও আবাসন ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে, সেখানে জেনানা প্রথা এখনও অনুসৃত হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]

আরও দেখুন পর্দা; হারেম।