জুরী পদ্ধতি

জুরী পদ্ধতি  এক ধরনের যৌথ বিচারব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সংখ্যক জুরীগণ আইন বিষয়ে শিক্ষা বা ডিগ্রি লাভ না করেও আদালতে বিচারকের সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী বা নির্দোষ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। জুরী পদ্ধতির বিচারব্যবস্থা প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়ভাবে প্রচলিত ছিল; তবে এ বিচারব্যবস্থা পদ্ধতিগতভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিচারব্যবস্থা থেকে ছিল স্বতন্ত্র। এ ব্যবস্থায় জুরীদের এবং বিচারকের কাজ পৃথক ছিল। জুরীদের দায়িত্ব ছিল মূলত ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটন; বিচারকের কাজ ছিল সংশ্লিষ্ট মামলায় আইন ও বিধির প্রতি লক্ষ্য রেখে আইনগত প্রশ্নে সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও অপরাধের প্রকৃতি সম্পর্কে জুরীদের অবহিত করা এবং অতঃপর জুরীদের সিদ্ধান্তের আলোকে রায় ঘোষণা করা।

আধুনিক জুরী পদ্ধতির বিচারব্যবস্থার উদ্ভব হয় ইংল্যান্ডে। ১৭২৬ সালে কলকাতায় মেয়র আদালত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভারতে জুরী পদ্ধতির প্রচলন করা হয়। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টকে জুরী পদ্ধতির বিচারব্যবস্থার আওতাভুক্ত করা হয় এবং তখন থেকে আদালতের বিচার কাজে জুরী পদ্ধতির অনুশীলন শুরু হয়। কোম্পানির আওতাধীন রাজ্যসমূহে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় শ্রেণীর আদালতেই জুরী পদ্ধতি চালু করা হয়। কিন্তু গোষ্ঠীগত পক্ষপাতিত্বের কারণে বিচারের ক্ষেত্রে প্রবর্তিত এ সংস্কার কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। এ পদ্ধতিতে খ্রিস্টানদের বিচার করার জন্য জুরী হিসেবে শুধু খ্রিস্টানদেরই তালিকাভুক্ত করার বিধান করা হয়। অ-খ্রিস্টান ভারতীয়দের বিচারের ক্ষেত্রে ভারতের সকল ধর্মের অনুসারীদের জুরী তালিকাভুক্ত করার বিধান রাখা হয়। এতদ্প্রেক্ষিতে প্রচলিত এ আইনের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন কোম্পানি সরকার এ বৈষম্য সংশোধন করতে বাধ্য হয়।

১৮৬১ সালের হাইকোর্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে তৎকালীন বাংলার জেলাসমূহে জুরী পদ্ধতির বিচারব্যবস্থা চালু হয়। কলকাতা হাইকোর্টের জুরী পদ্ধতির বিচারব্যবস্থা শুধু ইউরোপীয় এবং কলকাতার নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। উক্ত বিচারব্যবস্থায় কেবলমাত্র ফৌজদারি বিচারকার্যই সম্পন্ন হতো। সেসময়ে দায়রা জজ জুরীদের অধিকাংশের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়ে রায় প্রদানে বাধ্য ছিলেন। আইনি পেশার সংগে যুক্ত নন এমন স্থানীয় লোকদের নিয়ে সেসময় দায়রা আদালতের জুরী বোর্ড গঠন করা হতো। দায়রা আদালতের শুনানিতে জুরীদের বেজোড় সংখ্যায় বাছাই করা হতো। তাদের সংখ্যা ৩ থেকে ৯ জন পর্যন্ত হতো। জুরীদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রায় প্রদান বিচারকের জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। ১৯৫৯ সালে সামরিক আইন রেগুলেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানে জুরী পদ্ধতির বিচারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]