জীন ব্যাংক

জীন ব্যাংক (Gene bank)  মূল জীন উপাদানসহ বীজ টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ বা উদ্ভিজ্জ উপাদান সংরক্ষণের স্থান। জীন ব্যাংক হতে পারে কৃত্রিম পরিবেশে (ex situ) যেখানে বিভিন্ন উদ্ভিদের বীজ বা অন্যান্য অংশ তাদের জন্মানোর স্থানের বাইরে সংরক্ষণ করা হয় বা প্রাকৃতিক পরিবেশে (in situ) যেখানে উদ্ভিদসমূহকে বিভিন্ন ধরনের ফসলের সম্পর্কযুক্ত বন্য উদ্ভিদসমূহসহ প্রাকৃতিক সংরক্ষণ স্থানসমূহে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। জীন ব্যাংকে বীজ আকারে এবং বহিরাঙ্গনে জমিতে উদ্ভিদসমূহ সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। স্থান বাঁচাতে এবং ব্যয় হ্রাস করতে কাঁচের পাত্রে (গবেষণাগার পরিবেশে– in vitro) টিস্যু কালচার রূপে কতিপয় উদ্ভিদ সংরক্ষণের ওপর বর্তমানে গবেষণা চলছে। উদ্ভিদের অঙ্গজ উপাদান অধিক সময়ের জন্য সংরক্ষণের কৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে শীতল সংরক্ষণ (cryopreservation) গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে যেখানে- ১৯৬°সে এ টিস্যু কালচার করা সম্ভব হয়েছে। কিছু বিশেষ ধরনের জীন ব্যাংকে মিউট্যান্টের মতো বিভিন্ন সংগৃহীত কৌলিতাত্ত্বিক উপাদান সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণকৃত বীজ দুই ধরনের হয়: প্রচলিত বীজ (orthodox seed) যেগুলি শুকিয়ে আর্দ্রতা শতকরা ৪ থেকে ৬ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস করা যায় এবং ২০° সে এর মতো নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়, এবং বীজ যেগুলি এ ধরনের শুষ্ককরণ বা নিম্নতাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না। বীজ উৎপন্ন করে না বা বীজ সংরক্ষণ করা যায় না, সে সব ফসলকে সাধারণত মাঠ জীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়। জীব দেহে জীন সকল জীবতাত্ত্বিক কর্মকান্ডের নীলনক্সা (information blueprint) এবং উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবসমূহের বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। আর তাই কোনো জীবে জীনসমূহ একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও একক সমন্বয় এবং বর্তমানে জীন ব্যাংকই একমাত্র স্থান যেখানে পদ্ধতিগতভাবে উদ্ভিদের (genotypes) সংরক্ষণ হয়। আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রসমূহে পরামর্শদাতা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৪ সালে উদ্ভিদ কৌলিতাত্ত্বিক সম্পদ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বোর্ড (International Board for Plant Genetic Resources/IBPGR) প্রতিষ্ঠা করা হয়। IBPGR প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্বব্যাপী কৌলিতাত্ত্বিকসম্পদ কেন্দ্রসমূহের সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং জার্মপ্লাজম সংগ্রহের বেশকিছু কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের ও কৃষিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানসমূহের সংরক্ষণ কার্যক্রমে IBPGR অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-এ পদ্ধতিগত জার্মপ্লাজম সংরক্ষণের সূচনা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটবাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পাট সংস্থা (International Jute Organization/IJO) ও বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সারা বিশ্বে জন্মানো পাট ও এর সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য ফসলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে ১৯৭৪ সালে জীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ জীন ব্যাংকে এ পর্যন্ত দেশি ও বিদেশি উৎসসমূহ থেকে সংগৃহীত প্রায় ৭,৫০০ জাত সংরক্ষণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৫,০০০ জাত জীন ব্যাংকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জাপানি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (Japanese International Cooperation Agency/JICA) সহায়তায় ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ সুযোগ-সুবিধাসহ আধুনিক জীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় সক্রিয় সংগ্রহের (active collection) সংরক্ষণ পূর্বের মতোই রয়ে গেছে, তবে মধ্যম মেয়াদি সংরক্ষণ ব্যবস্থা walk-in type থেকে একক হিমায়নযন্ত্র ব্যবস্থায় (unit refrigerator system) উন্নতি সাধন করা হয়েছে।

মূল সংগ্রহ (base collection) হিসেবে নিরাপদ ও দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৌলিতাত্ত্বিক সম্পদ কেন্দ্রে (Genetic Resources Centre/GRC) বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জার্মপ্লাজমের অনুরূপ সেট সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মধ্যে জার্মপ্লাজম বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সহজেই আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জীন ব্যাংকের সুবিধা পেতে পারে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের জীন ব্যাংক IJO-এর কেন্দ্রীয় জার্মপ্লাজম ভান্ডার (Centralized Germplasm Repository/CGR) এবং পাট ও সম্পর্কযুক্ত অাঁশজাতীয় ফসলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ কৌলিতাত্ত্বিক সম্পদ ইনস্টিটিউটের (International Plant Genetics Resources Institute/IPGRI) মনোনীত বিশ্ব ভান্ডার হিসেবে কাজ করে। IJO থেকে মোট ২০০৫টি সংযোজন (accessions) গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে ৫৯৩৬টি সংযোজন সংরক্ষিত রয়েছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট জীন ব্যাংকে যার সংরক্ষণ তাপমাত্রা ২০°সে। এসব জার্মপ্লাজমের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ ও মূল্যায়নে IJO উদ্ভাবিত সর্বনিম্ন বর্ণনাকারী তালিকা (minimal descriptors list) অনুসরণ করা হয়। দেশে তুলা উন্নয়ন বোর্ডে তুলার জার্মপ্লাজমের মোট ৪০৩টি সংযোজন রয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্ট ফসল গবেষণা কেন্দ্রসমূহ ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে বিভিন্ন ধরনের ডাল ও তৈলবীজ; ষাটের দশকের মাঝামাঝি গম এবং সত্তরের দশকের শেষদিকে অপ্রধান দানাজাতীয় ফসলের স্থানীয় জাতগুলির সংগ্রহ ও ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে শাকসবজি, মূলজাতীয় ফসল, কন্দাল ফসল ও মশলাজাতীয় ফসলও সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন পরিচালিত খামারসমূহ মাঠ পর্যায়ের জীন ব্যাংক হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফলের প্রায় ৮১৭টি জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করছে বলে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়। অন্যদিকে বনজ উদ্ভিদের কৌলিতাত্ত্বিক সম্পদ দুভাবে সংরক্ষণ করা হয়: প্রাকৃতিক পরিবেশগত শ্রেণী যেমন জাতীয় পার্ক, ব্যবস্থাপনাধীন প্রকৃতি সম্পদ, বহুমুখী ব্যবহার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বহির্ভূত শ্রেণী যেমন, সংরক্ষিত প্লট, ক্লোনাল ব্যাংক, arboretum প্রভৃতি। দেশের বিভিন্ন উদ্ভিদতাত্ত্বিক বাগান ফিল্ড জীন ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে বর্তমানে চা ও কফির মতো পানীয় ফসলের মোট ৩২০টির জার্মপ্লাজম ক্লোন ও বীজরূপে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত জীন ব্যাংকে ১০,০০০ এর অধিক সংযোজন (accessions) সংরক্ষিত রয়েছে।

বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট সংগৃহীত সকল জার্মপ্লাজম মাঠে সংরক্ষণ করা হয়। মোট প্রায় ৯১২টি সংযোজনের মধ্যে ১৫০টি জার্মপ্লাজম পৃথক প্রজনন বাগানে (breeding garden) সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ইক্ষুর কৌলিতাত্ত্বিক অবক্ষয় একটি মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রধানত নতুন নতুন জাতের প্রবর্তন, মিউটেশন ব্রিডিং এবং মাতৃউদ্ভিদ (parent materials) উন্নয়নে জার্মপ্লাজম ব্যবহূত হয়।  [মোঃ সিরাজুল ইসলাম]

আরও দেখুন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট