চৌধুরী, মিজানুর রহমান

মিজানুর রহমান চৌধুরী

চৌধুরী, মিজানুর রহমান (১৯২৮-২০০৬)  রাজনীতিক, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯২৮ সালের ১৯ অক্টোবর কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ হাফিজ চৌধুরী এবং মাতা মাহমুদা চৌধুরী। চাঁদপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে তিনি নুরিয়া হাই মাদ্রাসায় নিউ স্কিম কোর্সে পড়াশুনা করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ফেনী কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার তাল মোহাম্মদ হাটের বামনী জুনিয়র হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এই বিদ্যালয়ে থাকাকালেই প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নির্বাচিত হয়ে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে চাকরি ছেড়ে তিনি চাঁদপুরের নুরিয়া হাই মাদ্রাসায় (নিউ স্কিম) ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে বিনা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন।

মিজানুর রহমান চৌধুরী  ১৯৪৪ সালের প্রথমদিকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এ সময় তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের একজন সংগঠকের দায়িত্ব পান। ১৯৪৫ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের কুমিল্লা জেলা শাখার সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি মুসলিম লীগ ভলান্টিয়ার  কোরের ক্যাপ্টেন নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরী চাঁদপুর মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে তিনি ফেনী কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

মিজানুর রহমান চৌধুরী ১৯৫৯ সালে চাঁদপুর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে তিনি মুক্তিলাভ করেন এবং ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পুনরায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে প্রথমে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনকে সংগঠিত করেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ধর্মঘটের প্রধান সাংগঠনিক আহবায়ক ছিলেন। একই বছর ২২ জুন তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশে ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি সংযুক্ত বিরোধী দলের আহবায়ক মনোনীত হন। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মিজানুর রহমান চৌধুরী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের প্রথমদিকে তিনি চাঁদপুরের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের  সঙ্গে মিলিতভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ  তিনি মালেক উকিলসহ আরো কিছু সঙ্গী নিয়ে আগরতলায় পৌঁছান। ভারতে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সভায় তাঁকে মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগ সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্য ও বেতার দপ্তরের মন্ত্রী হন। চৌধুরী ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রিসভায় পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন এবং এশিয়ার একক সদস্য কোটা থেকে কমনওয়েলথ সংসদীয় সংগঠনের নির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। মিজানুর রহমান চৌধুরী ১৯৮৫ সালের ২ আগস্ট মন্ত্রিসভায় ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৮৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ৯ জুলাই তিনি এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন এবং ১৯৮৮ সালের ২৭ মার্চ মন্ত্রী পরিষদ বাতিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। মিজানুর রহমান চৌধুরী ১৯৮৬ সালে জিম্বাবুয়ের হারারেতে অনুষ্ঠিত অষ্টম জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের উপনির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতির সঙ্গে সামাজিক কর্মকান্ডেও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। ২০০১ সালে পুনরায় তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দলের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। [আবু মো. দেলোয়ার হোসেন]