গ্রন্থাগার উপকরণ সংরক্ষণ

গ্রন্থাগার উপকরণ সংরক্ষণ  গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত উপকরণসমূহ ক্ষতি বা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার প্রক্রিয়া। বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সাধারণত মূল্যবান পান্ডুলিপি, নানা ধরনের প্রকাশনা এবং পাঠের জন্য অন্যান্য উপকরণ, গবেষণাপত্র, রেফারেন্স গ্রন্থ প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। বিশেষ করে  কাগজ আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে প্রাচীন বাংলার গ্রন্থাগারগুলিতে তালপাতা, ভূর্জপত্র, বৃক্ষছাল প্রভৃতির উপর লিখিত  পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করা হতো এবং সেসময়ের পাঠকেরা এসকল পান্ডুলিপি থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় বিষয় পাঠ করতো। হাতে তৈরী কাগজের প্রচলন শুরু হলে লেখার উপকরণ হিসেবে এ কাগজের ব্যবহার শুরু হয় এবং তখন থেকে সতেরো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গ্রন্থাগারগুলিতে হাতে লেখা কাগজের পান্ডুলিপি, ক্ষুদ্র চিত্র, দলিল, নথি এবং চুক্তিপত্র সংগৃহীত হতে থাকে।

এসব উপকরণে ব্যবহূত কাগজের প্রধান উপাদান হল সেলুলোজ যা আলো, তাপ ও আর্দ্রতার প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং সহজেই  ছত্রাক, ক্ষতিকর পোকামাকড়, গুবড়ে পোকা এবং অন্যান্য  কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হয়। অধিকন্তু বায়ুমন্ডলের উচ্চ আর্দ্রতায় এ উপকরণসমূহ স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ে। আগেকার দিনের গ্রন্থাগারিকগণ পান্ডুলিপি এবং অন্যান্য উপকরণসমূহের স্যাঁতসেঁতেভাব দূরীকরণ এবং ছত্রাক, পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ ধ্বংসের জন্য সরাসরি সূর্যের আলোতে মেলে রাখতো। কীটপতঙ্গ বিতাড়ক হিসেবে তারা গ্রন্থাগারে পাতাসহ নিমের ছোট একটি ডাল ঝুলিয়ে রাখত এবং বইয়ের তাক বা শেলফ অথবা বাক্সের মাঝে কালিজিরা কাপড়ের পুটলিতে বেঁধে রেখে দিত। কিছু পান্ডুলিপি লাল কাপড় বা লালশালু দ্বারা মুড়ে দেয়া হতো, সম্ভবত এর উদ্দেশ্য ছিল বইপুস্তক নিরাপদে রাখা, কীটপতঙ্গ বিতাড়ন এবং ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা করা। এ ছাড়াও পান্ডুলিপি রচয়িতাগণ কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে পান্ডুলিপিকে রক্ষা করার জন্য নিম কাঠ দ্বারা বিশেষভাবে নির্মিত আবরক ব্যবহার করতো।

আঠারো শতক থেকে গ্রন্থাগারগুলিতে বিভিন্ন ধরনের কাগজে ছাপানো বইপত্র, জার্নাল, মানচিত্র, সনদ, নথিপত্র এবং মাইক্রোফিল্ম সংগৃহীত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে শ্রুতি টেপ (audio tape), শ্রুতি-দর্শন ক্যাসেট (audio-video cassette) এবং চলচ্চিত্র ফিল্ম প্রভৃতিও সংগৃহীত হতে থাকে এবং সেসঙ্গে জাতীয় সম্পদ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশ হিসেবে জাতীয় সংরক্ষণাগারে সংগৃহীত হতে থাকে বিভিন্ন পুরানো গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ ও রেকর্ডপত্র। এইসব উপকরণ আলো, তাপ, আর্দ্রতা, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ, এসিডজাতীয় গ্যাস ইত্যাদির প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং সহজেই ছত্রাক, ক্ষতিকর পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এসকল ক্ষতিকর উপাদানের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে গ্রন্থাগার উপকরণাদির মধ্যে কালো দাগ পড়া, বাদামি হয়ে যাওয়া, অস্বচ্ছতা, দুর্বল হয়ে পড়া, ভঙ্গুরতা এবং অম্লধর্মীতা প্রভৃতি দেখা দেয় যার ফলে উপকরণগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেকাংশেই কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। এ কারণে গ্রন্থাগারের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার সীমা সবসময়ের জন্যই যথাক্রমে ৬০% এবং ২০° সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখতে হয়। এ প্রক্রিয়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে রক্ষা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রন্থাগারগুলিরই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সামর্থ্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারসমূহ, গণগ্রন্থাগার এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর গ্রন্থাগারের মতো বৃহৎ গ্রন্থাগারগুলিতে কাঙ্ক্ষিত আদর্শ আর্দ্রতামান রক্ষা করা হয় স্বল্পমূল্যের আর্দ্রতা হ্রাসকারী যন্ত্র (dehumidifier) দ্বারা। প্রয়োজনীয় পরিমাণ বৈদ্যুতিক পাখা চালিয়ে তাপমাত্রা কমিয়ে রাখা হয়। কীটপতঙ্গ বিতাড়ক হিসেবে ন্যাপথালিন ব্যবহূত হয় এবং এগুলি বইপত্র, পান্ডুলিপি, চিত্র এবং নথিপত্রাদির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

তালপত্র, ভুর্জপত্র, কাগজ এবং শ্রুতি-দর্শন টেপ ইত্যাদির প্রধান উপাদান সেলুলোজ হওয়ায় এসকল উপকরণ সংরক্ষণে ইউরোপে বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহূত হচ্ছে। বাংলাদেশে গণগ্রন্থাগার, জাতীয় যাদুঘর গ্রন্থাগার, জাতীয় আর্কাইভ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিতে ব্যবহূত আধুনিক কিছু পদ্ধতি নিচে বর্ণিত হলো:

বাষ্পধৌতকরণ (Fumigation)  ছত্রাক, পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত সকল ধরনের গ্রন্থাগার উপকরণকে রক্ষার একটি কার্যকর প্রক্রিয়া। এ কৌশলের জন্য প্রয়োজন একটি কাঠের প্রকোষ্ঠ যেখানে কিছু তারের জাল নির্মিত শেলফে বিশেষ ব্যবস্থায় গ্রন্থাগার উপকরণাদি রাখা হয় এবং শেলফের নিচের তাকে রক্ষিত পাত্রে বাষ্পধৌতকারী থাইমল (thymol) নির্যাস রেখে শেলফের দু পার্শ্বে দুটি ৬০ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। সমগ্র কার্যক্রমটি সম্পন্ন করতে সাত থেকে পনের দিন ধরে অব্যাহতভাবে দৈনিক ২ থেকে ৩ ঘণ্টা বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এরপর উপকরণসমূহ সরিয়ে পরিষ্কার করে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়। ধাতব প্রকোষ্ঠে বায়ুশূন্য বাষ্পধৌতকরণ পদ্ধতিতে ধৌতকারী উপাদান হিসেবে প্যারা-ডাইক্লোরোবেনজিন (para dichlorobenzene) ব্যবহূত হয়। ইথিলিন অক্সাইড, কার্বন-ডাই-সালফাইড ইত্যাদিও বাষ্পধৌতকারী নির্যাস হিসেবে ব্যাবহূত হয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, গণগ্রন্থাগার এবং বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘর গ্রন্থাগারে থাইমল বাষ্পধৌতকরণ প্রকোষ্ঠ রয়েছে।

পরিষ্কারকরণ (Cleaning)  সংরক্ষণ ব্যবস্থার দ্বিতীয় ধাপ হলো পরিষ্কারকরণ কার্যক্রম যা দু ধরনের: (১) ভৌত পরিষ্কারকরণ এবং (২) রাসায়নিক পরিষ্কারকরণ। দু ধরনের রাসায়নিক পরিষ্কারকরণের মধ্যে একটি হচ্ছে (ক) জলীয় ধৌতকরণ, এবং অপরটি (খ) অ-জলীয় বা শুষ্ক ধৌতকরণ।

ভৌত পরিষ্কারকরণ  পরিষ্কারকরণের ভৌত পদ্ধতিতে গ্রন্থাগারে জমে থাকা ধুলা, ঝুল ইত্যাদি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হয় এবং সেলুলোজ তৈরী উপকরণে জমে থাকা ধুলাবালি, ঝুল কাপড়ের ডাস্টার বা নরম ব্রাশ দিয়ে কিংবা কখনও কখনও ডাস্ট ক্লিনার-এর সাহায্যে পরিষ্কার করা হয়।

কালি স্থায়ীকরণ  কাগজ এবং কাপড়ের উপকরণের উপর লিখিত লেখার কালি এবং কিছু কিছু রঙ পানি অথবা জৈব দ্রাবকে সহজে দ্রবণীয়। এসব উপকরণ ধৌত করার পূর্বে লেখার কালি এবং রঙকে মিথানলে দ্রবনীয় নাইলন অথবা টলুইনে দ্রবণীয় পিভিএ (পলি ভিনাইল এসিটেট)-এর সাহায্যে স্থায়ী করা হয়।

অ-জলীয় ধৌতকরণ  উপকরণাদি পানি ব্যতীত ধৌতকরণ। অত্যন্ত খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কাগজ ও কাপড়ের পান্ডুলিপি যেগুলি পানির সংস্পর্শে এলে অধিকতর ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলি অ-জলীয় ধৌতকরণের প্রয়োজন হয়। মিথানল, পেট্রোলিয়াম, ডাইক্লোরোইথেন, ডাই এসিটোন এলকোহল প্রভৃতি জৈব দ্রাবকের সাহায্যে অ-জলীয় ধৌতকরণ করা হয়।

পুনরুদ্ধারকরণ (Restoration)  সেলুলোজে তৈরী উপকরণ পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন প্রকার পুনরুদ্ধারকরণ ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যবস্থাগুলি হচ্ছে পেস্টিং, লেমিনেশন, রিফু করা, তালি দেওয়া, কাপড়ের আস্তরণ, ফালি আস্তরণ, প্রলেপ, দৃঢ়করণ প্রভৃতি।

লেমিনেশন (Lamination)  কাগজ দিয়ে তৈরী উপকরণ সংরক্ষণের জন্য প্রচলিত একটি পদ্ধতি। দু ধরনের লেমিনেশন পদ্ধতি রয়েছে: (১) দ্রাবক লেমিনেশন এবং (২) তাপীয় লেমিনেশন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞগণ দ্রাবক লেমিনেশন পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকেন, অপরদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞগণ সংরক্ষণ পরীক্ষাগারের তাপীয় লেমিনেশন পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকেন। দ্রাবক লেমিনেশন পদ্ধতিতে এসিডমুক্তকৃত ছেঁড়া বা ভঙ্গুর কাগজকে দু স্তর সেলুলোজ এসিটেটের পাতলা ফিল্ম এবং পরে দু স্তর এসিডমুক্ত টিস্যু কাগজ দিয়ে উভয় পার্শ্ব থেকে আবৃত করা হয়। দু পার্শ্বের সেলুলোজ এসিটেট ফিল্মকে এসিটোন দ্রবন প্রয়োগ করে শোষণকারী তুলা নিয়ে হাতের মৃদু চাপের দ্বারা মিশিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে কাগজ অনেকটা প্লাস্টিকে পরিণত হয় এবং উপকরণটি বিপদমুক্ত থাকে। তাপীয় লেমিনেশন কৌশলের বেলায়ও কাগজকে দুই স্তর সেলুলোজ এসিটেট ফিল্ম দিয়ে আবৃত করা হয় এবং ১০০° সে তাপমাত্রায় লেমিনেশন যন্ত্রের মধ্যে এক মিনিট রেখে বের করে আনা হয় যার মধ্যে কাগজটি প্রায় প্লাস্টিকের রূপ নেয়। দু ধরনের লেমিনেশন পদ্ধতিতেই ব্যবহূত সেলুলোজ এসিটেট ফিল্মের বিয়োজনের ফলে এবং এসিডিক বিক্রিয়ার কারণে কাগজের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে থাকে, যে কারণে উন্নত দেশসমূহ এ ব্যবস্থা বর্জন করছে। [মোঃ ছাবের আলী]