গোপীনাথ কবিরাজ, মহামহোপাধ্যায়

গোপীনাথ কবিরাজ, মহামহোপাধ্যায় (১৮৮৭-১৯৭৬)  সংস্কৃত পন্ডিত, দার্শনিক। ১৮৮৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার ধামরাই গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল  টাঙ্গাইল জেলায়। পিতা বৈকুণ্ঠনাথ ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে পন্ডিত এবং প্রখ্যাত দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সহপাঠী। গোপীনাথের জন্মের কয়েক মাস আগেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তাঁদের কুলগত উপাধি ছিল ‘বাগচী’, ‘কবিরাজ’ উপাধি নবাবি আমলে প্রাপ্ত।

গোপীনাথ ঢাকার জুবিলি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করার পর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে  কলকাতা যান। সেখানে কিছুদিন অধ্যয়নের পর স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি জয়পুর স্টেটের দীউয়ান সংসারচন্দ্র সেনের সহায়তায় জয়পুর যান এবং সেখান থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড নম্বর পেয়ে তিনি এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরের বছর কাশীর সরস্বতী ভবনের গ্রন্থাগারিক হিসেবে গোপীনাথ কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯২৪ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন।

অধ্যাপনা পেশা থেকে অবসর নিয়ে গোপীনাথ দর্শনচর্চা ও ধর্মসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। এর আগেই ১৯১৮ সালে তিনি বিখ্যাত তান্ত্রিক ও দার্শনিক যোগী বিশুদ্ধানন্দের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন।  পালি ভাষায় তাঁর গভীর পান্ডিত্য ছিল। কাশীতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি খ্যাতনামা অধ্যাপক ড. ভেনিসের নিকট এপিগ্রাফি ও প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন। ড. ভেনিসের অধীনে প্রাচীন ইতিহাসের রহস্যোদ্ধার বিষয়ে তিনি কয়েক বছর গবেষণাও করেন।

গোপীনাথ স্কুলজীবনেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। কাশীতে চাকরি করার সময় তিনি সরস্বতী ভবন গ্রন্থাগারের ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক অনেকগুলি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সেসব গ্রন্থে তিনি পান্ডিত্যপূর্ণ যেসব ভূমিকা লিখেছিলেন সেগুলি তখনকার পন্ডিতমহল কর্তৃক প্রশংসিত হয়। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের সমস্ত শাখায়, এমনকি বৌদ্ধদর্শনেও তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। পরিণত বয়সে তিনি কাশ্মীরী শৈবতন্ত্রের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন এবং তাতে ভারতীয় জীবনদর্শনের মূল খুঁজে পান। তাই এ তান্ত্রিক দর্শনের মাধ্যমেই তিনি সর্বমানবের মুক্তির সাধনা করেন।

গোপীনাথের ছাত্র ও শিষ্যদের মধ্যে খ্যাতনামা কয়েকজন হলেন বারাণসীর সংস্কৃত বিদ্যাপীঠের আচার্য নরেন্দ্র দেব, অখন্ড মহাযোগ সঙ্ঘের পন্ডিত সীতারাম, বিখ্যাত যক্ষ্মারোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাম অধিকারী প্রমুখ। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে  সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: শ্রীশ্রীবিশুদ্ধানন্দ প্রসঙ্গ, তান্ত্রিক সাধনা, ভারতীয় সাধনার ধারা, শ্রীকৃষ্ণ প্রসঙ্গ, মৃত্যুবিজ্ঞান ও কর্মরহস্য, ত্রিপুরারহস্যম্, গোরখসিদ্ধান্তসংগ্রহঃ, সাহিত্যচিন্তা, Saraswati Bhavan Studies, Aspects of Indian Thought ইত্যাদি।

ভারতীয় দর্শনের সকল বিভাগে অগাধ পান্ডিত্যের কারণে জীবৎকালেই গোপীনাথ একজন প্রবাদপুরুষে পরিণত হন। পান্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা মূল্যবান উপাধিতে ভূষিত হন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারত সরকার প্রদত্ত ‘মহামহোপাধ্যায়’ (১৯৩৪) ও ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬৪) উপাধি, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিলিট ডিগ্রি (১৯৪৭), উত্তরপ্রদেশ সরকার প্রদত্ত ‘সাহিত্য বাচস্পতি’ (১৯৬৫) উপাধি এবং বিশ্বভারতী প্রদত্ত ‘দেশিকোত্তম’ (১৯৭৬) উপাধি। দেশের বাইরেও তাঁর পান্ডিত্যের খ্যাতি ছিল। ১৯৭৬ সালের ১২ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।  [সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী]