গঞ্জ

গঞ্জ (চক, হাট, বাজার)  প্রাক-আধুনিক ধারণায় গঞ্জ হলো এমন একটি সংরক্ষিত সুবিধাজনক স্থান যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা ও ফড়িয়াগণ নির্দিষ্ট সময়ে স্থানীয় বা অস্থানীয় উৎপন্ন দ্রব্য ও শস্যাদি বেচাকেনা করে। গঞ্জের কাছাকাছি ধরনের অপরাপর মোকাম হলো চক, হাট ও বাজার। এ স্থানগুলি গঞ্জের মতো ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কমবেশি একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়, যদিও এদের মধ্যে সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। মুগল নথিপত্রে দু ধরনের গঞ্জের উল্লেখ দেখা যায়, খাস অর্থাৎ সরকারি ‘গঞ্জ’ এবং বেসরকারি গঞ্জ। গঞ্জগুলি ছিল সরকারের রাজস্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। জমিদার ও তালুকদারগণ প্রধানত বেসরকারি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করতেন। জমিদারগণ গঞ্জ থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি অংশ শুল্ক হিসেবে সরকারকে প্রদান করতেন। অনেক গঞ্জ লাখেরাজ হিসেবে ‘সায়ের’ শুল্ক থেকে মুক্ত ছিল। লাখেরাজ গঞ্জ পদস্থ কর্মচারীদের সুবিধা হিসেবে এবং পেনশন প্রাপ্তদের ক্ষতিপূরণ বাবদ মঞ্জুর করা হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম দিকের সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, নওয়াবের হারেমের সদস্যসহ কিছু অসৎ লোক বাংলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ গঞ্জের মালিক ছিল। নায়েব নাজিম সৈয়দ মুহম্মদ রেজা খান (১৭৬৫-১৭৯১) লাখেরাজ গঞ্জ হিসেবে বৈরামগঞ্জের মালিক ছিলেন। এ ছাড়া মীরজাফর-এর স্ত্রী মুন্নী বেগম এর অধীন ছিল বাবুগঞ্জ, জগৎ শেঠএর হাতে ছিল মাহতাবগঞ্জ। এ সকল গঞ্জে টোল আদায় একটি রীতিসিদ্ধ প্রথায় পরিণত হয়েছিল। টোল প্রদানের বিষয়টি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বণিকরা মেনে নিলেও ইউরোপীয়রা বিশেষ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ কর প্রদানকে ঘৃণার চোখে দেখত। তারা মনে করত যে, রাজকীয় ফরমান এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ কর প্রদান ব্যতীত বাণিজ্য করার অধিকার তাদের রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গঞ্জে টোল আদায়কে কেন্দ্র করে নওয়াবের কর্মচারী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

নগরায়নের অভাবে এবং গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এ সকল বিশাল গঞ্জ উৎপাদন ও বন্টনের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। সাধারণ গঞ্জসমূহে সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর আদানপ্রদান চলত এবং এমন বিশেষ গঞ্জও ছিল যেখানে বিশেষ ধরনের দ্রব্যসামগ্রীর বেচাকেনা চলত। পশু, বস্ত্র, নৌকা, দাস, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য মালামাল ক্রয়বিক্রয়ের জন্য বিশেষ গঞ্জও গড়ে উঠেছিল।  [সিরাজুল ইসলাম]