খিজিরপুর

খিজিরপুর  মধ্যযুগের একটি নগর। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহরের মাইলখানেক উত্তরে এককালে দুলাই (পুরাতন বুড়িগঙ্গা) ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ছিল এই নগর। রেনেল-এর মানচিত্রে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে খিজিরপুরের অবস্থান নির্দেশ করা হয়েছে। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত খিজিরপুর নগরী ভাটির নরপতি  ঈসা খান মসনদ-ই-আলা কর্তৃক নির্মিত। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে কাত্রাবু থেকে তাঁর প্রশাসনিক সদর দফতর সোনারগাঁয়ে স্থানান্তরের অব্যবহিত পরেই সম্ভবত তিনি নগরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ঈসা খান খিজিরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন বলেও জানা যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক নারায়ণগঞ্জের অদূরে হাজিগঞ্জ দুর্গকে খিজিরপুর কিল্লা নামেও অভিহিত করেছেন। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, খিজিরপুর নগরটি হাজিগঞ্জ এলাকার অতি সন্নিকটেই অবস্থিত ছিল। প্রাচীর বেষ্টিত এ নগর ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। সেকালে পূর্বদিক থেকে ঢাকা অভিমুখী একমাত্র জলপথটি এ নগর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ঈসা খান ও তাঁর উত্তরাধিকারী মুসা খানের (১৫৯৯-১৬১১) শাসনকালে নগরটি ছিল একটি শক্তিশালী সামরিক খাঁটি। খিজিরপুর ছিল তৎকালে বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রধান নৌবন্দর, এবং এ বন্দর থেকেই তখন বড় ধরনের সব নৌঅভিযান পরিচালিত হতো।

মুগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে (১৬১০) প্রথম পরাজয়ের পর  মুসা খান শীতলক্ষ্যা নদীকে প্রধান প্রতিরোধ-সীমা নির্ধারণ করে নতুনভাবে যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। সেসময় তিনি শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে অবস্থিত খিজিরপুর নগর সম্ভবত স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে নদীর পূর্বতীর ব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুগল সুবাহদার  ইসলাম খান খিজিরপুর দখল করে সেখানে তাঁর নৌবহর ও গোলন্দাজ বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মুসা খানের পতনের পর মুগলরা খিজিরপুরকে তাদের নৌবাহিনীর এক শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করে।

খিজিরপুরের সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করে মুগল সুবাহদার মীরজুমলা (১৬৬০-১৬৬৩) একটি সড়ক নির্মাণ করে রাজধানী শহর ঢাকার সঙ্গে খিজিরপুরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন। পাকা সেতু সংযোগসহ অপর একটি সড়ক দ্বারা সোনারগাঁ শহরের সঙ্গে স্থলপথে খিজিরপুরের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ সড়কটি খিজিরপুর থেকে সোনারগাঁয়ে পূর্বদিকে বৈদ্যের বাজার এবং উত্তরদিকে পানাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মীরজুমলা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বা এর কাছাকাছি সময়ে পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের ঢাকা অভিমুখে অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার লক্ষ্যে যখন কয়েকটি জলদুর্গ নির্মাণ করেন তখন তিনি খিজিরপুরেও একটি দুর্গ নির্মাণ করেন বলে অভিমত রয়েছে। কিন্তু খিজিরপুরে শুধুমাত্র একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্বের নিরীখে প্রতীয়মান হয় যে, মীরজুমলা খিজিরপুরে কোনো নতুন দুর্গ নির্মাণ করেন নি, বরং ঈসা খান কর্তৃক নির্মিত দুর্গটিই মুগল আদলে সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করেছেন।

ধ্বংসপ্রাপ্ত খিজিরপুর নগরীর স্থাপনার মধ্যে শুধু টিকে আছে বিবি মরিয়ম মসজিদ ও  বিবি মরিয়মের সমাধিসৌধ। দুর্গ এলাকাটি জুড়ে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার ব্রিগেডের সদর দফতর।

মুগল আমলে সরকার বাজুহার অন্তর্গত একটি পরগণা ছিল খিজিরপুর, এবং এই খিজিরপুরই ছিল পরগণার প্রশাসনিক কেন্দ্র।  [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]