ক্রাইটন, হেনরি

ক্রাইটন, হেনরি (১৭৬৪-১৮০৭)  স্কটল্যান্ডের অভিযাত্রিক ও নিজ মালিকানায় ব্যবসায়ী ক্রাইটন হেনরি চার্লস গ্রান্ট-এর সহকর্মী ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। সীমিত সাফল্য এবং একজন দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মধ্যযুগের গৌড় শহরের ধ্বংসাবশেষের প্রাচীন নিদর্শনসমূহ ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান কার্য পরিচালনা করে মধ্যযুগের প্রত্নতত্ত্বের একজন পথ প্রদর্শকে পরিণত হন।

ক্রাইটন ১৭৮৩ সালে ১৯ বছর বয়সে চার্লস গ্রান্টের কার্যালয়ে (১৭৪৬-১৮২৩) একজন ব্যবসা সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এ সময় চার্লস গ্রান্ট মালদায় অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির  সিল্ক ও সুতিবস্ত্র রপ্তানিকারক কারখানায় কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মালদায় চার্লস গ্রান্টের পদমর্যাদা ছিল লোভনীয় এবং অচিরেই তিনি প্রচুর সম্পদ অর্জন করেন। এই সম্পদের মধ্যে ছিল গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অবস্থিত গোয়াতিমালা নামক স্থানে একটি নীলচাষের কারখানা। চার্লস গ্রান্ট ১৭৮৬ সালে ক্রাইটনকে গোয়াতিমালার নীল কারখানার ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। ১৭৭০ সালে গ্রান্ট পরিবারিক কারণে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হলে ক্রাইটনকে এই কারখানা পরিদর্শনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। অকালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত (১৮০৭) ক্রাইটন বেশ কিছু নীল কারখানা স্থাপন করে ব্যবসার প্রভূত উন্নতিসাধন করেন।

হেনরি ক্রাইটন একজন শৌখিন চিত্রশিল্পী ছিলেন এবং তাঁর চিত্রশিল্পের বিষয়বস্ত্তর খোঁজে অবসর সময়ে তিনি প্রায়ই গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যেতেন। অচিরেই এসব ধ্বংসাবশেষ ও প্রাচীন নিদর্শনসমূহের প্রতি তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন এবং এসবের মধ্যে তিনি ঐতিহাসিক গুরুত্বের সন্ধান পান। তিনি অত্যন্ত কষ্ট স্বীকার করে গভীর জঙ্গলে আবৃত গৌড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ভগ্নাবশেষ ও বিচ্ছিন্ন শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন। সেই সঙ্গে তিনি তাঁর কাজের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন ও  গোয়াতিমালার কারখানার ছাদে যত্নসহকারে সংরক্ষণ করেন। গোয়াতিমালায় প্রাপ্ত এসব অভিলেখন এবং প্রাচীন নিদর্শনসমূহ জাহাজে করে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় এবং পরবর্তীকালে এগুলো ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সরকারি সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়।

ক্রাইটন গৌড়ে বিদ্যমান সব স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন, কিছু কিছু স্মৃতিসৌধের নকশা অঙ্কন করেন, এবং ফিরুজ মিনারের মতো ভাঙ্গা অট্টালিকার সংস্কারসাধন করেন। প্রাচীন নিদর্শনসমূহের প্রতি আগ্রহের কারণে তিনি পান্ডুয়া যান এবং সেখানে আদিনা মসজিদের সবিস্তৃত স্থাপত্য নকশা তৈরি করেন। ধীরে ধীরে তিনি গৌড় ও এর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের ধ্বংসাবশেষের নকশা সংরক্ষণের একটি বড় খাতা তৈরি করেন। ১৮০১ সালে তিনি গৌড় শহরের প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক জরিপ শেষ করেন এবং এর ধ্বংসাবশেষসমূহের বিস্তৃত মানচিত্র তৈরি করেন। তিনি তাঁর জরিপ মানচিত্রের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা মার্কুইস অব ওয়েলসলির (১৭৯৮-১৮০৫) গভর্ণর জেনারেলকে উপহার দেন। ক্রাইটনের মৃত্যুর এক বছর পর (১৮০৮) তাঁর ছয়টি মানচিত্র খোদাই করা হয় এবং জেমস মোফাট কর্তৃক কোলকাতায় প্রকাশিত হয়। ১৮১৭ সালে গৌড়ে তাঁর কর্মতৎপরতার ফলাফল দি রুইনস অব গৌড় নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ক্রাইটনের পরিবারকে সহায়তা প্রদানের জন্য তাঁর পান্ডুলিপি এবং নকশাসমূহকে সংকলন করে ডেসক্রাইবড এন্ড রিপ্রেজেন্টেড ইন এইটিন ভিউজ উইথ এ টপোগ্রাফিক্যাল ম্যান শিরোনামে গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়।

ক্রাইটন তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় ধ্বংসাবশেষের প্রাকৃতিক বিবরণের বর্ণনা করেন এবং রুবেন ব্যুরো ও জেমস রেনেলের মতো পূর্ববর্তী পরিদর্শনকারীদের অভিজ্ঞতার বিষয় উল্লেখ করে এগুলোর সংরক্ষণের অবস্থা তুলে ধরেন। গৌড়ের অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষের খোদাইকৃত ক্ষুদ্র মানচিত্র টমাস মেডল্যান্ড কর্তৃক ১৮টি চমৎকার জল-রং দ্বারা বর্ণনা করা হয় এবং এগুলোর প্রত্যেকটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রদান করা হয়। এসব চিত্রের মধ্যে রয়েছে তোরণ (দাখিল, চাঁদ, কোতোয়ালী ও গুমতি) মসজিদ (বড় সোনা, ছোট সোনা, তাঁতি পাড়া, লট্টন ও চামকাটি), মিনার (ফিরুজ মিনার), সমাধি (হুসেন শাহের সমাধি, ছোট সোনা মসজিদের সমাধি), ধর্মীয় অট্টালিকা (কদম রসুল) এবং শহরের কিছু ক্ষুদ্র অট্টালিকা। তাঁর গৌড় জরিপের মানচিত্র ছোট আকারে গ্রন্থের পরিশিষ্টে দেওয়া হয়েছে।

ক্রাইটনের প্রকাশিত প্রতিবেদন একটি বিলুপ্ত শহর ও তার ইতিহাস পুনরুদ্ধারের প্রথম প্রচেষ্টা, যা সে সময় একেবারে অজানা ছিল। তাঁর নকশাসমূহ একটি ধ্বংপ্রাপ্ত শহরের ধারাবাহিক চিত্র তৈরি করে যা একান্ত উপভোগ্য আকর্ষণীয় অনুচিত্র। কিছু কিছু দিক থেকে অবাস্তব ও রোমান্টিকতায় পূর্ণ হলেও এগুলো একটি অনাবিষ্কৃত বিষয়ের উপর প্রথম মানচিত্রায়ন।

ক্রাইটন ছিলেন সুসমাচার মতবাদ অনুসারী, খ্রিস্টধর্ম এবং তাঁর নিয়োগকর্তা চার্লস গ্রান্ট এর উদ্দীপনায় বিশ্বাসী। নিজ আবাসভূমি গুয়ামালতী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থানীয় শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য বেশ কিছু অবৈতনিক বাংলা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সমগ্র দেশে মিশনারি কর্তৃক এরূপ খ্রিস্টান নার্সারির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মিশনারি কর্তৃক তা বাস্তবায়নের জন্য তিনি একটি পরিকল্পনাও গ্রহণ করেন।

১৮০৭ সালের ২ অক্টোবর ৪৪ বছর বয়সে ক্রাইটন এর মৃত্যু হয়। বহরমপুর সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি ৭ সন্তান ও স্ত্রী ফ্রান্সিসকে (ফ্রান্সিস স্লুপার্ট) রেখে যান। ক্রাইটন এর বহরমপুর সমাধির সমাধিস্তম্ভে  যে কথাগুলো লেখা ছিলো (বর্তমানে হারিয়ে গেছে);

‘‘...দেশীয় বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক যিনি নিজ মাতৃভাষায দরিদ্র জনগণের সন্তানদের শিক্ষাদান করে পথনির্দেশ করেন। এভাবে তিনি একটি জেলাকে আলোকিত ও সভ্য করেন এবং নৈতিক শিক্ষা ও ইউরোপিয় অগ্রগতির উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন...।’’ [প্রতীপ কুমার মিত্র]

গ্রন্থপঞ্জি Henry Creighton, The Ruins of Gaur: Described and represented in eighteen views with a topographical map, London, 1817; J Moffat, Views of Calcutta, Berhampore, Monghyr and Benars, Calcutta, 1805-10; William Francklin, Journal of a Route from Rajemahal to Gour, AD 1810-11, Shillong, 1910;  CB Lewis, The Life of John Thomas, Surgeon of the Earl of Oxford East Indiaman, and First Baptist Missionary to Bengal,London, 1873; CR Wilson, List of Inscriptions on Tombs or Monuments in Bengal. Possessing Historical or archaeological interest, Calcutta, 1896; Gautam Sengupta and Sheena Panja (ed), Archaeology of Eastern India: New perspectives, Kolkata, 2002.