কেওড়া

কেওড়া সুন্দরবনের গরান বনাঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলির মধ্যে একটি। কেওড়া, Sonneratia apetala লম্বা ও বেড়ে যথাক্রমে প্রায় ২০ মিটার ও প্রায় ২.৫ মিটার। নতুন জৈববর্জ্য সমৃদ্ধ, মোটামুটি বা অধিক লবণযুক্ত মাটিতে এ গাছ ভাল জন্মে। কেওড়া বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারে বিস্তৃত। পাতা সরল, বিপরীতমুখী, অখন্ড ও চামড়ার মতো। ফুল উভলিঙ্গ। ফল প্রায় গোলাকৃতির এবং ব্যাস ২-৩ মিলিমিটার। একটি ফলে বীজের সংখ্যা ২৫-১২৫। বাংলাদেশে প্যানেল বানানো, প্যাক করার বাক্স তৈরী, আসবাবপত্র ও জ্বালানির জন্য কেওড়ার কাঠ ব্যবহূত হয়। গাছের ঘের ন্যূনতম ৩০ সেমি হলে ২০ বছর বয়স্ক গাছ কাটা হয়।

কেওড়া বাংলাদেশে ব্যাপক গরান বন সৃষ্টিতে প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি হিসেবে গণ্য। সমুদ্র উপকূলীয় নতুন জৈববর্জ্য সমৃদ্ধ অঞ্চলের শতকরা ৯৫ ভাগ বাগানকে এ প্রজাতির গাছ একাই গড়ে তোলে। আগস্টে কেওড়ার পাকা ফল সংগৃহীত হয় এবং ফল থেকে বীজ পাওয়া যায়। নার্সারি বেডে বা চারা লাগানোর জমিতে চারাকে বড় করে বর্ষায় লাগানো হয়। সম্প্রতি ১.৫ মি × ১.৫ মি দূরত্বে চারা লাগানো হচ্ছে।

গরানবনের অন্যান্য গাছের তুলনায় কেওড়ার বৃদ্ধি বেশ দ্রুত। এর আলোর চাহিদা খুব বেশি। গাছ উপরের দিকের মূল থেকে তীক্ষ্ণ শ্বাসমূল উৎপাদন করে। নিবিড় বনে গাছ মাত্র একটি খাড়া গুড়ির বিকাশ ঘটায় যা এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রজাতির গাছ থেকে অধিকতর দীর্ঘ হয়। অবশ্য, পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর অতি দ্রুত গাছের অবনতি শুরু হয়।

কেওড়া গাছ


কান্ড ছিদ্রকারী Zeuzera conferta কেওড়া গাছের ক্ষতিকর এক পতঙ্গ। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও সমুদ্র উপকূলবর্তী দ্বীপাঞ্চল জুড়ে আশ্রয় বেষ্টনী গড়ে তোলার জন্য যে উপবন তৈরি করা হয় তাতে কেওড়া প্রজাতির গাছ ব্যাপকভাবে লাগানো হয়। ১৯৮৩ সালে চর কাসেমে কেওড়া গাছ ছিদ্রকারী এ পোকা প্রথম শনাক্ত করা হয়।

লার্ভা বাকলে ছিদ্র করে ঢোকে, পরে গাছের কাষ্ঠল অংশে ছিদ্রটিকে বড়, ডিম্বাকৃতির ও শাখা-প্রশাখাযুক্ত সুড়ঙ্গে পরিণত করে। প্রাথমিক অবস্থায় বাকলের উপর দাগ পড়ে। লার্ভা দানাদার মলের বড়ি ও কাঠ থেকে সৃষ্ট ফ্রাসকে (frass) বাইরে ছুড়ে ফেলে যা গাছের গোড়ায় জমা হয়। একটি গাছের কান্ড শত শত লার্ভাকে আশ্রয় দিতে পারে। যদিও এ অনিষ্টকারী পোকা দ্বারা আক্রান্ত গাছ সরাসরি মারা যায় না, তথাপি বহু সুড়ঙ্গ সৃষ্টি হওয়ার কারণে গাছ বাতাসের প্রতি সংবেদনশীল হয়। লার্ভা সৃষ্ট গর্ত ও সুড়ঙ্গ কাঠ ক্ষয়কারী ছত্রাকের আক্রমণের পথ হিসেবে কাজ করে। কেওড়া ছাড়া এ ক্ষতিকর পতঙ্গ গরানবনের Sonneratia caseolaris, Avicennia officinalis, A. alba ও Tamarix indica গাছেও আগ্রাসন চালায়। কাঠঠোকরা ও শিকারি পিঁপড়া এসব ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ আহার করে বলে জানা যায়। গরান বনাঞ্চলে রোপিত সব এলাকার জরিপে দেখা গেছে যে, আক্রান্ত গাছের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৫২ ভাগ, অথচ সুন্দরবন অঞ্চলে আক্রান্ত হওয়ার গড় হার শতকরা প্রায় ২২ ভাগ।

এই ক্ষতিকর পতঙ্গ দমনের সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে পতঙ্গ দ্বারা বেশি আক্রান্ত গাছ শনাক্ত করে কেটে ফেলা; কেওড়ার সঙ্গে গরানবনের উপযুক্ত প্রজাতির গাছ রোপণ করে মিশ্রবন গড়ে তোলা; আক্রান্ত গাছগুলি থেকে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গমুক্ত গাছ বেছে নেওয়া; ক্ষতিকর কীটপতঙ্গমুক্ত গাছের অপেক্ষাকৃত উত্তম বীজ রোপণ করা; গরানবন থেকে কেওড়া ছাড়া অন্যান্য যেসব গাছকে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ আক্রমণ করে সেসব গাছ সরিয়ে ফেলা এবং কম প্লাবিত উঁচু অঞ্চলে কেওড়ার পরিবর্তে অন্য প্রজাতির গাছ রোপণ করা ইত্যাদি। [নিয়াজ আহমেদ সিদ্দিকী এবং এম ওয়াহিদ বকশ]