কেওট

কেওট বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এই নৃগোষ্ঠীর লোকজন মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার  চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের আদিনিবাস দক্ষিণ বঙ্গের নিম্নাঞ্চল। খেয়া পারাপার তাদের আদি পেশা এবং নিজেদেরকে কেওটমাল্লা বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। চা বাগান শুরু হওয়ার সময়ে তাদেরকে ব্রিটিশরা সিলেটে নিয়ে আসে এবং তারা চা বাগানকেন্দ্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে কেওট সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৪ হাজার।

কেওট নৃগোষ্ঠী ৪টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলি হচ্ছে খরহাট, চাইমাল্লা, সুরাইয়া এবং লহবড়িয়া। নিজ বংশমধ্যে বিবাহ কেওট সমাজে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একই বংশের সদস্যরা সাত পুরুষ পর্যন্ত জন্ম ও মৃতাশৌচ পালন করে। তারা নিজেদেরকে শূদ্রবর্ণের বলে দাবি করে। কেওট সমাজ পিতৃপ্রধান। পরিবারে পিতাই প্রধান এবং মা সেখানে সহযোগী মাত্র। পুত্রসন্তানেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় এবং মেয়েরা সেখানে বঞ্চিত। বিয়ের পর নব দম্পতি বরের পিতৃগৃহেই অবস্থান করে এবং সেখানেই নতুন সংসার শুরু করে। সধবা মহিলা সিঁথিতে সিঁদুর ও হাতে শাঁখা ব্যবহার করে। কেওটদের মধ্যে যৌতুক প্রথাও বিদ্যমান।

কেওট জাতির প্রধান ভাষা বাংলা। তবে নিজেদের মধ্যে তারা হিন্দীভাষাও ব্যবহার করে থাকে। কেওটদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম। আর্থিক দুরবস্থার জন্য কেওট মা-বাবা ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে চা বাগানের কাজে লাগিয়ে দেয়। এটি তাদের  শিক্ষার হার হ্রাসের প্রধান কারণ।

ভাত কেওটদের প্রধান খাদ্য। তারা শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, মুগ, মসুর, খেসারি, অড়হর ডাল খায়। শূকর ও গোমাংস তারা আহার করেনা। চা তাদের অন্যতম প্রিয় পানীয়। সাধারণত কেওটরা বাড়িতে মদ প্রস্ত্তত করে না, তারা অর্থের বিনিময়ে মদ কিনে পান করে। বিড়ি, সিগারেট ও পানসুপারি কেওটদের নিকট খুবই প্রিয়। পৌষ সংক্রান্তি অর্থাৎ আলন্তির দিনে বাড়িতে তারা পিঠা তৈরি করে। কচ্ছপের মাংস তাদের অন্যতম প্রিয় খাদ্য।

কেওটরা অধিকাংশই শিবের পূজারী। দেবী হিসেবে তারা কালীদেবীকে আরাধনা করে। কেনো বিপর্যয় দেখা দিলে তারা সম্মিলিতভাবে দেবীর থানে পূজা-অর্চনা করে। এ ছাড়া কেওটরা লক্ষ্মী, স্বরস্বতী, কার্তিক, শনি, গণেশ, সত্যনারায়ণ প্রভৃতি দেবদেবীর পূজা-অর্চনা করে থাকে। শারদীয়  দুর্গাপূজা তাদের একাধারে বড় পূজা এবং  উৎসবরথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাসযাত্রা, হোলি উৎসব, গাজন উৎসব, বারুনী ও অষ্টমীস্নান তাদের উৎসবের দিন। কেওট জাতি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিন্ডদান সম্পর্কে তারা সজাগ এবং এ কাজের জন্য সামর্থ্যে কুলালে তারা গয়াধাম গমনে বিশেষ আগ্রহী থাকে। গয়া, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, হরিদ্বার প্রভৃতি তাদের প্রধান প্রধান তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত।

কেওট সমাজে অসবর্ণ (ভিন্ন বংশ ও বর্ণ) বিবাহ প্রচলিত। তাদের সমাজে ছেলে ও মেয়ের বয়স যখন তেইশ ও সতেরো বছর অতিক্রম করে তখনই বিয়ের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। কেওট সমাজে এক বিবাহ প্রথা প্রচলিত। কনের পিতাও বরকে কিছু টাকা উপঢৌকন দেয়। এই অনুষ্ঠানকে কেওটরা ছেক্না বলে। ছেক্না অনুষ্ঠানের পর তিলক অনুষ্ঠান পালিত হয়। এরপর লগনবাড়ি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে কাঁচাহলুদের গুঁড়ার সঙ্গে সরিষার তৈল মেশানো হয়। বিয়ের দিন সকালে কনের পিতৃগৃহে সত্যনারায়ণ পূজা হয়। পূজায় একজন ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্য করেন। সত্যনারায়ণ পূজা শেষে বর ও কনে উভয়ের পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে পবিত্র জল তর্পণ করা হয়। বিয়ের দিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে বর তার দলবলসহ কনের পিতৃগৃহে আগমন করে। সেখানে প্রথমেই কনের মা আরতির মাধ্যমে বরকে বরণ করে নেয়। সবাইকে জলযোগে আপ্যায়ন করা হয় এবং একে কেওটরা জলপান বলে। বরযাত্রীদের জলযোগ শেষ হলে বরকে মান্ডুয়া অর্থাৎ বাঁশের তৈরি সুসজ্জিত মঞ্চে বসানো হয়। এখানে কনে বরকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে এবং কনের পিতা বরের হাতে কনেকে সম্প্রদান করেন। বিয়ের তিনদিন পর বরের পিতৃগৃহে গাওনা নামে একটি অনুষ্ঠান পালিত হয়। সেদিন বরের পিতা কর্তৃক একটি ভোজসভার আয়োজনের মাধ্যমে বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।

কেওটদের মাঝে সামাজিক কোনো সংকট সৃষ্টি হলে সমাজের বয়স্ক নেতারা মীমাংসা করেন। কেওট সমাজে গ্রাম পঞ্চায়েত প্রথা চালু রয়েছে। পঞ্চায়েতের প্রধান কাজ হচ্ছে কোনো গোলযোগ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিরসন করা।

কেওট পুরুষেরা বাঁশের সাহায্যে নানা প্রকারের ঝুঁড়ি তৈরিতে বেশ দক্ষ। চা বাগানের কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে তারা বাঁশ ও বেতের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের সুদৃশ্য ঝুঁড়ি তৈরি করে নানা উৎসব, মেলা ও সাপ্তাহিক হাটে বিক্রয়ের মাধ্যমে বাড়তি উপার্জন করে। কেওট মহিলারা নাচেগানে বেশ পারদর্শী। হোলি, দোলযাত্রা প্রভৃতি উৎসবে তারা নাচগান পরিবেশন করে থাকে।  [সুভাষ জেংচাম]