কুমারী পূজা

কুমারী পূজা তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে  কালীপূজাজগদ্ধাত্রীপূজা ও অন্নপূর্ণাপূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন আছে। শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে বধ করার পর থেকে। কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করলে বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। তারপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন হয়। যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্ত্র, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্ত্রসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।

কুমারী পূজা, রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা

কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যেকোনো কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত  ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সমধিক প্রচলিত। এক থেকে ষোলো বছর বয়সী কুমারী মেয়ের পূজা করা চলে। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুই বছরের সরস্বতী, তিন বছরের ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কালিকা, পাঁচ বছরের সুভগা, ছয় বছরের উমা, সাত বছরের মালিনী, আট বছরের কুব্জিকা, নয় বছরের কালসন্দর্ভা, দশ বছরের অপরাজিতা, এগারো বছরের রুদ্রাণী, বারো বছরের ভৈরবী, তেরো বছরের মহালক্ষ্মী, চৌদ্দ বছরের পীঠনায়িকা, পনেরো বছরের ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ষোলো বছরের অন্নদা বা অম্বিকা।

কুমারী মেয়েকে মনে করা হয় সর্ববিদ্যাস্বরূপিণী। কুমারী পূজা ব্যতীত দেবতার পূজা, হোম ইত্যাদি কোনো কিছুই সফল হয় না। ভক্তদের বিশ্বাস, এর দ্বারা কোটি গুণ ফললাভ হয়, সকল বিপদ দূরীভূত হয়; কুমারীভোজনে ত্রিলোকভোজনের ফল হয়। কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ লাভ। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সে ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ এক মহত্তম সাধনপদ্ধতি। এ সাধনায় সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। এ ভাবনায় ভাবিত হয়েই  রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। কুমারী পূজার মাধ্যমে এ সত্যই তুলে ধরা হয়।

বর্তমানে কুমারী পূজার বহুল প্রচলন নেই, তবে পুণ্যকর্ম হিসেবে কুমারীকে দানভোজনে আপ্যায়িত করার প্রথা কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে কুমারী পূজার প্রচলন যে বহু আগে থেকেই ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় কুমারীপূজাপ্রয়োগ নামক গ্রন্থের  পুথি থেকে (বাংলা একাডেমী সংগ্রহ- ১৫৯, লিপিকাল ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ)। বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সিলেট, হবিগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলাশহরে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজার প্রচলন আছে। প্রতিবছর দুর্গাদেবীর মহাষ্টমী পূজাশেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মতান্তরে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের কুমারী পূজা খুবই আকর্ষণীয়। এ উপলক্ষে সেখানে প্রচুর পুণ্যার্থী ও সাধারণ দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। [দুলাল ভৌমিক]