কার্পেন্টার, মেরী

মেরী কার্পেন্টার

কার্পেন্টার, মেরী (১৮০৭-১৮৭৭)  উদারপন্থি সংস্কারক। তিনি অ্যানা পেন ও রেভারেন্ড ল্যান্ট কার্পেন্টারের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ল্যান্ট কার্পেন্টার ছিলেন তাঁর সময়ের একজন খ্যাতনামা একত্ববাদী (unitarian) শিক্ষাবিদ। তাঁর পিতামাতা তাঁদের আদর্শে গড়া স্কুলেই মেরীকে প্রগতিশীল ক্লাসিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় দীক্ষা দেন। এ শিক্ষা তখনকার দিনে একজন মেয়ে কেন, অনেক ব্যাপারে ছেলেদের জন্যও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী।

পরবর্তীকালে মেরী তাঁর মা ও বোন কর্তৃক পরিচালিত মেয়েদের স্কুলে প্রধান শিক্ষক হন। তাঁর বাবার শিক্ষা ও অন্যান্য একত্ববাদী সংস্কারকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মেরী দরিদ্রদের শিক্ষা দানের ব্যাপারে ক্রমান্বয়ে বেশি ঝু্ঁকে পড়েন। ব্রিস্টলের লুইন্স মিডে তাঁর বাবার চ্যাপেলে দীর্ঘ দিন সানডে স্কুল টিচার (প্রতি রবিবারে বসে এমন খ্রিস্টান ধর্ম শিক্ষা স্কুল) হিসেবে কাজ করার পর মেরী ছিন্নমূলদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অচিরেই এটি এ ধরনের স্কুলের মডেল হয়ে ওঠে। তাঁর পরবর্তী কর্মকান্ডের মধ্যে ছিল রিফর্মেটরি স্কুল (নাবালক অপরাধীদের চরিত্র সংশোধনমূলক স্কুল) ও শ্রমভিত্তিক স্কুলের সূচনা। ইংল্যান্ডে এ জাতীয় স্কুলের মধ্যে এটিই প্রথম। তাঁর স্কুল দরিদ্র ও সমাজের অবহেলিত মানুষের শিক্ষার তৎপরতাকে দারুনভাবে প্রভাবিত করেছিল। মেরীর এ কর্মযজ্ঞ তাঁর সময়ের উদার সংস্কারক পরিমন্ডলে তাঁকে পরিণত করেছিল সবচেয়ে পরিচিত নারী হিসেবে। ১৮৫২ সালে একটি সংসদীয় কমিটিতে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মেরীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সময়ের বিবেচনায় একজন নারী হিসেবে এ ছিল এক অসাধারণ কৃতিত্ব।

১৮৬৬ থেকে ১৮৭৭ পর্যন্ত জীবনের শেষ দশকটি মেরী কার্পেন্টার স্বেচ্ছায় ভারতের শিক্ষা সংস্কারে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করেন। তাঁর এ সদিচ্ছা অবশ্য অঙ্কুরিত হয় ১৮৩২ সালে ব্রিস্টল ভ্রমণের সময় যখন তাঁর বাবার সাথে রাজা রামমোহনের সাক্ষাত হয়। ১৮৬০-এর দশকে রামমোহন রায় এর শেষ জীবনের ওপর স্মৃতিকথা লিখা এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভারতে এসে বাঙালিদের সাথে মেলামেশার ফলে উদার ও জাতিভেদ বিরোধী মানসিকতার মেরী কার্পেন্টার দারুনভাবে উদ্বুদ্ধ হন। নারী-পুরুষের সম-অধিকার ও কারা সংস্কার এ উভয় বিষয় দ্বারা অনুপ্রানিত মেরী কার্পেন্টারকে ভারতীয় ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষা সংস্কারকগণ তাঁর আসন্ন চারটি ভারত সফরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ঠাকুর পরিবার। ইংল্যান্ডে তিনি তাঁর ভারত বিষয়ক অভিজ্ঞতা সাগ্রহে প্রকাশ করেন। ভারতীয় সংস্কারকদের আকাঙ্ক্ষার কথা তাঁর চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসাল সায়েন্স-এর হলভর্তি দর্শকের সামনে তাঁর চমৎকার বক্তৃতা এবং ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Six Months in India মেরী কার্পেন্টারকে একজন প্রখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত করে। তিনি ভারতের তিনটি শহরে মহিলা নর্মাল স্কুল (অর্থাৎ শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল) প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি অনুদান সংগ্রহে সাহায্য করেন এবং পরবর্তী সময়ে ভারত ভ্রমণে তিনি বোম্বাই ও আহমদাবাদে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোর অপরাধীদের সাথে কৃত ব্যবহারে আতঙ্কিত মেরী কার্পেন্টার কয়েকটি আইন সংস্কারে প্রভাব খাটান। তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকটি শাখা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সহায়তা করেন এবং কেশবচন্দ্র সেনএর ইচ্ছায় ১৮৭০ সালে ইংল্যান্ডেও এর একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

মেরী কার্পেন্টার প্রকৃতপক্ষে কতখানি ভারতীয় পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পেরেছিলেন বা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রেণিস্বার্থ তাঁর মতো উদার মানসিকতার একজন ইংরেজ রমনীকে কতখানি আলোড়িত করতে পেরেছিল তা বিতর্কের বিষয়। তিনি অবশ্য উপমহাদেশের বহুবিধ বিশ্বাস ও আচার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণ ও পাশ্চাত্যকরণের মাধ্যমে বিজাতীয়করণের ব্যাপারে ভারতীয় সংস্কারবাদীদের শঙ্কার বিষয়েও সংবেদনশীল ছিলেন। তাই তিনি যে কোনো রকমের মিশনারি কর্মকান্ড থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। কারণ অনেক ভারতীয়ই একে একটি ঘৃণ্য বিষয় বলে মনে করত। তবে তিনি ব্রাহ্ম ও বেদ সমাজের ন্যায় অন্যান্য সংগঠন যে গুলি ব্রাহ্ম সমাজ এর দেখাদেখি গড়ে উঠেছিল সেগুলির শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সাথে নিবিড় যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। তাদের আস্তিকতামূলক ধর্ম বিশ্বাস এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষা ইংল্যান্ডের একত্ববাদীদের মতোই ছিল, যে একত্ববাদী সম্প্রদায় থেকে মেরী কার্পেন্টার উদ্ভূত ছিলেন। কিন্তু ভারতীয় এ সংস্কারবাদীগণ অবশ্যই অন্যান্য সংস্কারপন্থি ও জাতীয়তাবাদীগণের মতো ছিলেন না। তিনি সর্বান্তকরণে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন। তাঁর ভারতীয় অভিজ্ঞতা তাঁর স্বীয় চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। তবে তিনি উপস্থিত ছিলেন এমন কিছু অনুষ্ঠানে প্রচলিত রীতিনীতি লঙ্ঘিত হওয়ায় অন্যান্য ভারতীয়দের নাখোশ করে তোলে। ভাষাগত অসচ্ছন্দতার কারণে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু পুরুষ সংস্কারকদের সাথে মতবিনিময় করতে পারতেন এবং ভারতীয় মুসলমান ও দরিদ্রদের সাথে তাঁর খুবই কম যোগাযোগ ছিল। অবশ্য তাদের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল আন্তরিক এবং প্রাগসর।

ভারত পুনর্গঠনে মেরী কার্পেন্টারের সম্ভবত সবচেয়ে বড় অবদান হলো বিধবা ও ইউরেশীয় নারীদের শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া। আগ্রহের বিষয়সমূহের ব্যাপারে তাঁর পরিপূর্ণ ঐকান্তিকতা তাঁর একান্ত সমর্থকদেরও মাঝে মাঝে হতোদ্যম করেছে, তথাপি তিনি তাঁর, অদম্য ব্যক্তিত্ব এবং গবেষণা ও যুক্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ বক্তব্যের দ্বারা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কিন্তু অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সংযুক্ত দেশের সংস্কারকদের উষ্ণ প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।  [রূথ ওয়াটস]

গ্রন্থপঞ্জি  Mary Carpenter, Memoir of Joseph Tuckerman, DD of Boston (US), London, 1849; Mary Carpenter, The Last Days in England of the Rajah Rammohun Roy, London, 1866; Joseph Estlin Carpenter, The Life and Work of Mary Carpenter, London, 1879; Antoinette Burton, The White Woman's Burden, British Feminists and The Indian Woman, 1865-1915, Western Women and Imperialism, Women's Studies International Forum, XIII-4, 1990.