কামশাস্ত্র

কামশাস্ত্র যৌনবিষয়ক শাস্ত্র। এতে নরনারীর যৌনসম্পর্ক এবং যৌনজীবন কীভাবে সুখকর হতে পারে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া যৌনলক্ষণ অনুযায়ী নরনারীর শ্রেণিবিভাগ এবং কোন শ্রেণির নরের সঙ্গে কোন শ্রেণির নারীর যৌনসম্পর্ক সুখকর ও নিরাপদ হতে পারে সেসব বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

হিন্দু শাস্ত্রানুসারে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এ চতুর্বর্গের অনুশীলন সমান গুরুত্বের সঙ্গে করণীয়। এর যেকোনোটির অভাবে মানবজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কামকে উপেক্ষা করলে মানব সমাজই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ কারণে অন্য তিনটি বর্গের মতো কামকলাকেও হিন্দুশাস্ত্রে অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে। তাই কামকলা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন এবং এর সুষ্ঠু প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে অতি প্রাচীনকাল থেকেই কামশাস্ত্রের অনুশীলন চলে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক বা তার পূর্বে রচিত বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৬.২.১২-১৩, ৬.৪.২-২৮) কামশাস্ত্র অনুশীলনের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। পরে সতেরো শতক পর্যন্ত এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়। রচয়িতাদের মধ্যে অনেক বাঙালিও রয়েছেন। বাৎস্যায়নের কামসূত্র এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

কামশাস্ত্র রচনার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, মহাদেবের অনুচর নন্দী (নন্দীকেশ্বর?) প্রথম সহস্র অধ্যায়ে কামসূত্র রচনা করেন। এরপর ঔদ্দালক শ্বেতকেতু একে পাঁচশত অধ্যায়ে এবং বাভ্রব্য সপ্ত অধিকরণ ও দেড়শত অধ্যায়ে সংক্ষেপিত করেন। পরবর্তীকালে অনেকে বাভ্রব্যের গ্রন্থের একেকটি অধিকরণ নিয়ে পৃথক পৃথক গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু সেগুলি খন্ডিত ও বিস্তৃত হওয়ায় সেগুলির সারাংশ নিয়ে বাৎস্যায়ন সংক্ষেপে রচনা করেন কামসূত্র। এর রচনাকাল খ্রিস্টীয় তিন শতক বলে অনুমান করা হয়। এটি ৭টি অধিকরণ ও ৩৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে কামকলার পাশাপাশি ভারতীয় সমাজের অনেক অনুদ্ঘাটিত বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনের একটি সুন্দর চিত্র পাওয়া যায়।

কামসূত্র সর্ব ভারতে এতই জনপ্রিয় ছিল যে, পরবর্তীকালে এর অনেক টীকা রচিত হয়। সেসবের মধ্যে যশোধরের জয়মঙ্গলা এবং ক্ষেমেন্দ্রের বাৎস্যায়নসূত্রসার (১১শ শতক) উল্লেখযোগ্য। কামশাস্ত্রের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য মৌলিক গ্রন্থ হলো: দামোদরগুপ্তের কুট্টনীমত (৮ম শতক), কুচুমারের কুচোপনিষদ্ (১০ম শতক), পদ্মশ্রীজ্ঞানের নাগরসর্বস্ব (১০ম/১১শ শতক), ক্ষেমেন্দ্রের সময়মাতৃকা, কোক্কোকের রতিরহস্য (১২শ শতক), অনন্তের কামসমূহ (১৫শ শতক) ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে কোক্কোকের রতিরহস্য খুবই খ্যাতি লাভ করে, যে কারণে পরবর্তীকালে এর ওপর অনেক টীকাগ্রন্থ এবং তদনুসরণে অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচিত হয়। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: কাঞ্চীনাথের টীকা, জ্যোতিরীশ্বরের পঞ্চশায়ক (১৪শ শতক), ইম্মাদি পৌঢ়দেবরায়ের রতিরত্নপ্রদীপিকা (১৫শ শতক), কল্যাণমল্লের অনঙ্গরঙ্গ (১৫শ/১৬শ শতক) প্রভৃতি। এগুলির মধ্যে অনঙ্গরঙ্গ সমধিক খ্যাত। গ্রন্থটি জৌনপুরের শাসনকর্তা আহ্মদ খাঁ লোদীর পুত্র লাড় খাঁর নির্দেশে রচিত হয়েছিল। গ্রন্থটি বিশেষ খ্যাতি লাভ করায় লোকে একেই ‘কোকশাস্ত্র’ বলে জানত। সতেরো শতকে ব্যাসজনার্দন এটি অবলম্বনে কামপ্রবোধ রচনা করেন। লিজ্জৎ-অল্-নিসা নামে এর একটি ফারসি অনুবাদ হয়। উনিশ শতকে রিচার্ড বার্টন এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া উর্দু, ফরাসি এবং জার্মান ভাষায়ও গ্রন্থটির অনুবাদ হয়।

কামশাস্ত্র রচনায় বাঙালিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁদের রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে জয়দেবের রতিমঞ্জরী, মীননাথের স্মরদীপিকা, হরিহরের শৃঙ্গারদীপিকা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে মুদ্রিত-অমুদ্রিত উভয় প্রকার গ্রন্থই রয়েছে। অমুদ্রিত গ্রন্থগুলির  পুঁথি  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারসহ দেশের অন্যান্য গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। উল্লেখ্য, উপরিউক্ত গ্রন্থগুলির সবই সংস্কৃত ভাষায় রচিত।

কামশাস্ত্রের ব্যবহার জনজীবনের বাইরে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।  কালিদাস (কুমারসম্ভবম্, ঋতুসংহারম্, শৃঙ্গাররসাষ্টকম্), মাঘ (শিশুপালবধম্),  জয়দেব গীতগোবিন্দম্) প্রমুখ সংস্কৃত কবি তাঁদের রচনায় কামশাস্ত্রের ব্যবহার করেছেন। বাঙালি কবি  বড়ুু চন্ডীদাস (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন),  কাশীরাম দাস (মহাভারত) প্রমুখও এ শাস্ত্র ব্যবহার করেছেন। বাঙালি রচিত কয়েকটি সংস্কৃত প্রহসনেও কামশাস্ত্রের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোপীনাথ চক্রবর্তীর কৌতুকসর্বস্বম্ (১৬শ-১৮শ শতকের মধ্যে),  কবিতার্কিক-এর কৌতুকরত্নাকরম্ (১৭শ শতক) প্রভৃতি।  [দুলাল ভৌমিক]