কাইড, রবার্ট

কাইড, রবার্ট (১৭৪৬-১৭৯৩)  পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার শীবপুরে বোটানিকাল গার্ডেন এর প্রতিষ্ঠাতা। এ উদ্যান প্রতিষ্ঠার (১৭৮৭ সালে) পর ব্রিটিশ শাসিত ভারতে  উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে নতুন গতি আসে। রবার্ট কাইড-এর জন্ম ১৭৪৬ সালের ২৬ মে। একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তিনি ভারতে কর্মরত ছিলেন। উদ্ভিদ বিদ্যার ছাত্র অপেক্ষা তিনি ছিলেন সার্বিক দিক থেকে একজন উদ্যানপালক বা মালী। প্রয়োগবাদী ও উদ্যমী ব্যক্তি হিসেবে কাইড-এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো কলকাতার নিকট একটি ‘উদ্ভিদ উদ্যান’ গড়ে তোলা যার পশ্চাতে একটি সুনির্দিষ্ট বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিহীত ছিলো। গবেষণার জন্য কাইড খুব বেশি দুর্লভ উদ্ভিদ সংগ্রহের পক্ষে ছিলেন না; বরঞ্চ তিনি সেই সকল উদ্ভিদ সংগ্রহে বেশি আগ্রহী ছিলেন যার মধ্যে বাণিজ্যিক মূল্য বিদ্যমান ছিলো।

সে সময়ে, অর্থাৎ আঠারো শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ শাসিত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা প্রকার মসলা ও জায়ফল রপ্তানি করে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিক পরিমাণে মুনাফা অর্জন করছিলো। তবে এ রপ্তানি প্রক্রিয়ায় যে সমস্যা ছিলো তা হল, রপ্তানি পণ্য বহনের জাহাজসমূহ যে কাঠ দ্বারা নির্মাণ করা হতো, তা প্রচুর অর্থ ব্যায় করে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হতো। ফলে ১৭৮৬ সালে কাইড একটি উদ্ভিদ উদ্যান গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাব পেশ করলে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল স্যার জন ম্যাকফার্সন (১৭৮৫-৮৬) অত্যন্ত আনন্দিত হন। কারণ, জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রয়োজীয় কাঠ সংগ্রহের লক্ষ্যে একটি উদ্ভিদ উদ্যান গড়ে তোলার ব্যাপারে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির যে পরিকল্পনার ছিলো, তার সঙ্গে কাইড-এর পরিকল্পনা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো। প্রস্তাবিত উদ্যান সৃষ্টির পরিকল্পনার সঙ্গে এ অঞ্চলকে ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্ত অন্যান্য ভূখন্ডে অর্থকরী গাছ সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনার বিষয়টিরও ইঙ্গিত ছিলো। এতদসঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে এটাও স্পষ্ট হয়েছিলো যে, প্রস্তাবিত উদ্যান পরিকল্পনায় কোম্পানি তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরের ভূখন্ডেও বৃক্ষরোপণ করার অনুমতি পেতে পারতো।

উদ্যানের জন্য, কাইড তাঁর নিজের বসত বাড়ি সংলগ্ন ও শালিমার পয়েন্টের নিকটে হাওড়ার শীবপুরের বাগানে ৩০০ একর জমি নির্বাচন করেন। কর্নেল কাইড উদ্যানের জন্য নির্ধারিত জমিটি বেড়া ও গর্ত দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন। তিনি উক্ত জমিতে জাহাজ নির্মাণের উপযোগী কাঠের বৃক্ষ এবং ইউরোপে বিক্রির জন্য দারুচিনি, লবঙ্গ ও এলাচের মতো অর্থকরী মসলার গাছ ফলানোর পরিকল্পনা করেন। কর্নেল কাইড, উদ্ভিদবিদদের নিকট তাঁর উদ্যানে চা, তামাক, কফি, তুলা ও অন্যান্য বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক উদ্ভিদ ফলনেরও অভিপ্রায় ব্যাক্ত করেন। মালাক্কায় (মোলাক্কাস) ওলন্দাজগণ মসলার চাষ করে যেভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে একচেটিয়া মুনাফা অর্জন করছিলো, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিও কাইড-এর প্রস্তাবিত উদ্যানে সেই ধরনের গাছ, বিশেষ করে দারুচিনি ও অন্যান্য অর্থকরী মসলার গাছ রোপণে বেশি আগ্রহী ছিলো। কোম্পানি সে সময়ে উদ্যানে বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে জোসেফ ব্যাংকস-এর উপদেশকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলো। ব্যাংকস ছিলেন ক্যাপটেন কুক এর ‘এনডেভার’ নামক বিশ্ব ভ্রমণের সহযাত্রী। বনায়ন বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন ও বিশ্বভ্রমণকালে তিনি গ্রীষ্মমন্ডলীয় উদ্ভিদ সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কোম্পানির বাণিজ্যের প্রসার ও সমৃদ্ধির নিমিত্তে উদ্যানের জন্য নির্ধারিত উদ্ভিদ নির্বাচনে ব্যাংকস-এর পরামর্শ পরবর্তীতে কাইড-এর প্রস্তাব গ্রহণে সমর্থন যোগায় এবং সে কারণে ৩১ জুন ১৭৮৭ সালে কোর্ট অব ডায়রেক্টরস একটি চিঠি ইস্যুর মাধ্যমে কাইড-এর প্রস্তাবটির অনুমোদন প্রদান করলে তা কাউকে বিস্মিত করেনি। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো, উদ্যান তৈরির জন্য নির্ধারিত বেশ কিছু গ্রীষ্মমন্ডলীয় মসলা, ফল ও অন্যান্য উদ্ভিদ বাংলার জলবায়ুতে ফলনের উপযোগী ছিলো না। ফলে, কাইড-এর আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তাঁর অনেকগুলো পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অবশ্য উদ্ভিদ বিদ্যায় দক্ষ লোকের অভাবও তাঁর এই ব্যর্থতার আরেক কারণ হয়ে থাকতে পারে। তবে ভারত ভূখন্ডে উদ্ভিদবিদ্যা গবেষণার উন্নয়নে বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদের ব্যাপক উপাস্থাপনার জন্য রবার্ট কাইডকে অবশ্যই কৃতিত্ব দেয়া উচিত। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮২০ সালে যখন প্রতীয়মান হয় যে, উদ্যানে কাঠ বৃক্ষ জন্মানো সম্ভব ছিলো না, তখন উদ্যোনের জন্য নির্ধারিত জমির পরিমান ৩০০ একর থেকে কমিয়ে ২৭০ একরে আনা হয় এবং বাকি অংশ ‘বিশপ্’স কলেজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করা হয়।

রবার্ট কাইড শীবপুর উদ্ভিদ উদ্যানের অবৈতনিক সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে ২৬ মে ১৭৯৩ সালে, উদ্যান প্রতিষ্ঠার ঠিক ছয় বছর পরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর অধিকাংশ সম্পত্তি মেজর আলেকজান্ডার কাইডকে দলিল করে দান করে যান। ১৮২৬ সালে একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে আলেকজান্ডার কাইড এ মৃত্যু হয়। রবার্ট কাইড-এর স্থলাভিষিক্ত ড. উইলিয়ম রক্সবার্গ কর্তৃক একটি বাছাইকৃত স্থানে ১৭৯৫ সালে তাঁরই স্মরণে একটি চমৎকার মার্বেল পাথরের সাদা ভস্মাধার নির্মাণ করা হয়। ড. রক্সবার্গ ১৭৯৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত শীবপুর উদ্যানের প্রথম বেতনভুক সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন।

আক্ষরিক অর্থে উদ্ভিদবিদ না হলেও রবার্ট কাইড কলকাতা বোটানিক গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করে ভারতে উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে অধ্যায়নের পথে বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিলো, উদ্যানের অভ্যন্তরেই প্রিয় নাশপাতি ফলের বৃক্ষের নিচে তাঁকে সমাহিত করা হবে। কিন্তু অবশেষে রবার্ট কাইডকে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের সমাধিক্ষেত্রের দক্ষিণের শেষাংশে সমাহিত করা হয়।  [দিলীপ ব্যানার্জী]