কর্নওয়ালিস কোড

কর্নওয়ালিস কোড  ১৭৯৩ সালে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ৪৮টি রেগুলেশন বা আইন জারি করেন। উক্ত রেগুলেশন সাধারণভাবে কর্নওয়ালিস কোড নামে পরিচিত। কর্নওয়ালিস কোডের কয়েকটি উৎস হলো ১৭৭২ হতে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত জারিকৃত রেগুলেশন ও আদেশ, হিন্দু ও মুসলিম আইন, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সংক্রান্ত বিধিমালা এবং ব্রিটিশ আইন। কর্নওয়ালিস কোডের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উপযোগী একটি প্রাতিষ্ঠানিক আইনবিধান ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। ১৭৯৩ সালের ১ মে কর্নওয়ালিস তাঁর কোড ঘোষণা করেন। কর্নওয়ালিস কোডের সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

কর্নওয়ালিস কোডের প্রধান উপাদ্য বিষয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এ বন্দোবস্তের অধীনে জমিদারকে ভূমির একচ্ছত্র মালিক বলে ঘোষণা করা হয়। মালিক হিসেবে জমিদার তার ভূসম্পত্তি অবাধে হস্তান্তর বা দান করার অধিকার লাভ করেন। জমিদারির ওপর সরকারি রাজস্ব চিরকালের জন্য স্থিরীকৃত ঘোষণা করা হয়। চুক্তি মোতাবেক সরকারি রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হলে জমি নিলামে বিক্রয় করে বকেয়া আদায়ের ব্যবস্থা করা হয় (রেগুলেশন নং ১, ২, ৮, ১৪)।

ইতোপূর্বে জেলা কালেক্টর ছিলেন একাধারে রাজস্ব প্রশাসক, বিচারক ও ম্যাজিষ্ট্রেট। প্রতি জেলায় একজন জজ নিয়োগ করা হয় এবং প্রশাসন থেকে বিচার ক্ষমতা পৃথক করে সকল বিচার ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা জজের উপর ন্যস্ত করা হয়। কালেক্টরের অধীনে রাজস্ব কোর্ট বিলুপ্ত করে রাজস্ব সংক্রান্ত সকল বিচারও জেলা জজের আওতাভুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে বোর্ড অব রেভেনিউর রাজস্ব বিষয়ক বিচারক্ষমতা বিলুপ্ত করে তা দীউয়ানি আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত করা হয় (রেগুলেশন নং ২, ৩, ৪)। জেলা প্রশাসনে পদমর্যাদায় জেলা জজকে জেলা কালেক্টরের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। জেলা কালেক্টরের দায়িত্ব থাকে শুধু রাজস্ব সংগ্রহ এবং বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন সব প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন। প্রতি জেলায় স্থাপিত হয় একটি করে দীউয়ানি আদালত। বিচারের সুবিধার্থে ঢাকা, কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনায় স্থাপন করা হয় চারটি প্রাদেশিক আপীল আদালত (রেগুলেশন নং ৪, ৫)। সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সদর দীউয়ানি ও নিজামত আদালত।

১৭৯৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচারের এক্তিয়ার ছিল একমাত্র কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের, এবং কোম্পানির কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো বাঙালি বা ভারতীয় আদালতে মামলা করতে পারত না। এ বৈষম্য রদ করে আইনের চোখে সবাইকে সমান ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে, এমনকি সরকারের বিরুদ্ধেও স্থানীয় অধিবাসীদের আদালতে মামলা করার অধিকার দেওয়া হয় (রেগুলেশন ২৮)।

ইতোপূর্বে যেকোন ব্যক্তি আদালতে উকিল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। সে প্রথা রদ করে আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণের এবং পেশাদার উকিলের সাহায্যে আদালতে মামলা পরিচালনার নিয়ম প্রবর্তিত হয়। সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য সরকারি বেতনভূক উকিল নিয়োগ করা হয়, এবং বেসরকারি মামলা পরিচালনার জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত উকিলদের সনদ দেওয়া হয়। উকিলরা যাতে মক্কেলদের উপর অসঙ্গত অর্থভার চাপাতে না পারেন সেজন্য উকিলের ফি বেঁধে দেওয়া হয় এবং মক্কেলের নিকট থেকে আদালত কর্তৃক উকিলের ফি সংগ্রহ করার নিয়ম চালু হয় (রেগুলেশন ৭)। গ্রামাঞ্চলে পাতি মামলা-মোকদ্দমা স্থানীয়ভাবে সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য নেটিভ কমিশনার নিয়োগ করা হয়। নেটিভ কমিশনারের আদালতে অনুর্ধ্ব ৫০ টাকা মূল্যমানের মামলা গ্রহণের বিধান করা হয়। (রেগুলেশন ৪০)।

ইউরোপীয় সিভিলিয়ান কর্তৃক দেশিয় লোকদের ঋণ প্রদান এবং তাদের জন্য জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করা হয় (রেগুলেশন ৩৮)।

বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের দৈহিক নির্যাতন করার চিরাচরিত প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় এবং জমিদারদের সকল দাবি আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগের পরিবর্তে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার বিধান করা হয় (রেগুলেশন ১৭)।

কতিপয় বড় জমিদার পরিবারে প্রচলিত হিন্দু বা মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের বদলে শুধু পিতার জ্যেষ্ঠ জীবিত পুত্রের জমিদারির উত্তরাধিকার লাভের প্রথা প্রচলিত ছিল। জমিদারি অখন্ড রাখার উদ্দেশ্যে এ প্রথা অনুসরণ করা হতো। এ প্রথা বিলুপ্ত করে ছোট-বড় সকল জমিদারির ক্ষেত্রে হিন্দু বা মুসলিম উত্তরাধিকার আইন প্রয়োগ করা হয় (রেগুলেশন ১১)।

দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে দীউয়ানি ও ফৌজদারি আদালত বিচারকার্য পরিচালনা করত। ইউরোপীয় বিচারককে মুসলিম ও হিন্দু আইন বিষয়ে সহায়তা করার জন্য প্রতি আদালতে একজন করে মুসলমান ও হিন্দু আইন অফিসার নিয়োগ করা হয়।

দেশে প্রচলিত বহুবিধ অভ্যন্তরীণ সায়ের বা বাণিজ্য কর রহিত করা হয় (রেগুলেশন ২৭)।

জমিদারের পুলিশক্ষমতা প্রত্যাহার এবং জমিদারি পুলিশ বিলুপ্ত করে প্রতিটি জেলাকে কতিপয় থানায় বিভক্ত করা হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রত্যেক থানায় একজন দারোগা নিয়োগ করা হয়। দারোগার অধীনে থাকে বিশ বা তদুর্ধ্ব সংখ্যক সিপাই-বরকন্দাজ। এ ব্যবস্থায় থানার আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের পাকড়াও করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করা দারোগার দায়িত্ব (রেগুলেশন ২২)।

ইউরোপীয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নতুন আদালত প্রতিষ্ঠার ফলে কাজী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেশিয় আদালত বিলুপ্ত হয়। কাজীর কাজ হয় তখন দলিলাদি শনাক্ত করা এবং বিবাহ ও অন্যান্য মুসলিম ধর্মীয় উৎসবে পৌরোহিত্য করা (রেগুলেশন ৩৯)।

সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের জন্য জমি হস্তান্তর, সম্পত্তি সংক্রান্ত চুক্তি, বন্ধক প্রভৃতি রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করা হয় এবং নির্দেশ দেওয়া হয় যে, দান বিক্রয় ও উত্তরাধিকার বিভাজনের ফলে জমির মালিকানায় যে রদবদল হয় তা রেকর্ড করার জন্য কালেক্টর একটি পঞ্চসনা রেজিস্টার প্রস্ত্তত করবেন। পাঁচ বছর অন্তর উক্ত রেজিস্টার নতুন করে প্রস্ত্তত করা হবে। উক্ত রেজিস্টার ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল ভূমি মালিকানায় পরিবর্তন রেকর্ড করা (রেগুলেশন ৩৭, ৪৮)।

কর্নওয়ালিস কোডের সব আইন ও ব্যবস্থা মূলত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনে ঘোষণা করা হয়: ‘‘এখন থেকে জমির একমাত্র মালিক জমিদার। জমিদার তার ইচ্ছামতো জমি বিক্রয় করতে পারে, দান করতে পারে, বন্ধক রাখতে পারে। এর জন্য সরকারের কোনো পূর্বানুমতির প্রয়োজন নেই। সরকারকে দেয় জমিদারি রাজস্বে আর কোনো হ্রাসবৃদ্ধি হবে না। চিরকালের জন্য তা স্থির করা হলো এবং ভবিষ্যৎ কোনো সরকার এ নিয়মে পরিবর্তন আনতে পারবে না।’’ (রেগুলেশন ১, ৮)।  [সিরাজুল ইসলাম]