করতলব খান মসজিদ, ঢাকা

করতলব খান মসজিদ, ঢাকা পুরাতন ঢাকার বেগম বাজার এলাকায় অবস্থিত। ১৭০১-০৪ খ্রিস্টাব্দে দীউয়ান মুর্শিদকুলী খান ওরফে করতলব খান এটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি ‘বেগম বাজার মসজিদ’ নামেও পরিচিত।

করতলব খান মসজিদ, ঢাকা

সংযোজিত দোচালা অংশসহ মসজিদটি একটি উচু ভল্টেড প্লাটফর্মের পশ্চিমের অর্ধেক অংশ দখল করে আছে। প্লাটফর্মের পূর্বে রয়েছে একটি বাব বা বাউলি (ধাপকৃত কুয়া)। উত্তর-দক্ষিণে ৩৯.৬২ মি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩.৪১ মি প্লাটফর্মের উত্তর প্রান্ত খিলানাকৃতির। প্লাটফর্মের খিলানাকৃতির অংশটির মাঝ বরাবর কেটে একটি সমাধির জন্য জায়গা করা হয়েছে। সারকোফেগাসে মসজিদের প্রথম ইমামের নাম উৎকীর্ণ। প্লাটফর্মটির নিচে সারিবদ্ধভাবে একাধিক বর্গাকার ও আয়তাকার কক্ষ বিদ্যমান, যা এখন দোকানঘর হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। প্লাটফর্মের পূর্ব দিকে নতুন করে নির্মিত সিড়ি সম্বলিত একটি খিলানপথ রয়েছে। এ পথেই প্লাটফর্মের উপর নির্মিত মসজিদে প্রবেশ করা যায়। তুলনামূলকভাবে বড় একটি বাউলি নির্মিত হয়েছিল সম্ভবত উজু করার জন্য। একটি কক্ষের মধ্য দিয়ে সিড়ির কয়েকটি ধাপ বেয়ে নিচে নেমে এর পানি স্তরের নিকট পৌঁছা যায়। বাইরে থেকেও পানি উত্তলণের ব্যবস্থা আছে।

ভূমি নকশা: প্রথম তলা, করতলব খান মসজিদ


মূল মসজিদ ও এর উত্তর দিকে সংযোজিত দোচালা অংশ ভল্টেড উচু চত্বরের পশ্চিমাংশের অর্ধেক জায়গা দখল করে আছে। বাকি অংশটি আদিতে খালি থাকলেও বর্তমানে এখানে একটি পাকা বারান্দা আছে। কোণার বুরুজসহ মূল মসজিদের পরিমাপ ২৮.৬৫ মি./ ৮.২৩ মি এবং প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে পাঁচটি খিলানপথ রয়েছে। প্রতিটি খিলানই অর্ধ-গম্বুজ ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং পাশে রয়েছে সরু অষ্টভুজাকৃতির ছোট মিনার (turrets), যা প্যারাপেট ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। উত্তর ও দক্ষিণ উভয় পার্শ্বের দেওয়ালের মাঝ বরাবর একটি করে দরজা আছে। পশ্চিম দেওয়ালের অভ্যন্তরভাগে রয়েছে অর্ধ-অষ্টভুজাকার পাঁাচটি মিহরাব কুলঙ্গি। পার্শ্বে ছোট বুরুজসহ সবগুলিই সম্মুখভাগে অভিক্ষিপ্ত। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে একটি তিন ধাপ বিশিষ্ট পাকা মিম্বার রয়েছে।

৫.৬০ মি × ৫.১৮ মি আয়তন বিশিষ্ট মসজিদটি অভ্যন্তর ভাগে আড়াআড়িভাবে স্থাপিত চারটি চতুর্কেন্দ্রিক খিলান দ্বারা পাঁচটি ‘বে’তে বিভক্ত। কেন্দ্রীয় বে’টি বর্গাকার এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য ছোট ছোট আয়তাকার বে’গুলি থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। প্রত্যেকটি বে গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজগুলি অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত এবং পদ্ম ও কলস চূড়ায় শোভিত। গম্বুজের ভার বহনে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা ঢাকার লালবাগ দুর্গ মসজিদ ও সাত গম্বুজ মসজিদে ব্যবহূত কৌশলের অনুরূপ। চার কোণের চারটি অষ্টভুজাকার কলস ভিত্তি শোভিত কর্ণার টাওয়ার অনুভূমিক প্যারাপেটকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। কর্ণার টাওয়ারগুলি নতুন করে নির্মিত ছোট গম্বুজসহ (cupola) বদ্ধ ছত্রী (kiosk) এবং পদ্ম ও কলস শোভিত শীর্ষচূড়া দ্বারা আচ্ছাদিত। সবগুলি টাওয়ারেরই ডান ও বাম উভয় পার্শ্বে সংযোজিত হয়েছে সরু মিনার যা প্যারাপেট থেকে উচু এবং ছোট গম্বুজ ও কলস ফিনিয়াল দ্বারা আচ্ছাদিত।

মসজিদের উত্তর পার্শ্বের আয়তাকার সম্প্রসারিত অংশটি বাঙালি দোচালা কুড়েঘর স্টাইলের ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত, যার প্রান্তগুলি অত্যন্ত বাঁকা ও ঝুলে পড়া। সম্প্রসারিত অংশটিতে (৬.১০ মি × ২.১৩ মি) দুটি দরজা রয়েছে; একটি পূর্ব দেওয়ালের মাঝ বরাবর, বর্তমানে নতুন করে নির্মিত এবং অন্যটি দক্ষিণ দেওয়ালের মাঝে। শেষোক্ত এ দরজা দিয়েই সম্প্রসারিত অংশের সাথে মূল মসজিদ সংযোজিত। সম্প্রতি সম্প্রসারিত অংশের উত্তর দেওয়ালে একটি জানালা স্থাপন করা হয়েছে। এ কক্ষটির অভ্যন্তর ভাগের চারদিকের দেওয়ালে বেশ কিছু আয়তাকার ও বর্গাকার কুলুঙ্গি রয়েছে, সম্ভবত সেলফ হিসেবে ব্যবহারের জন্য এগুলি নির্মিত। বাঁকানো ছাদটি বাইরের দিকে নিয়মিত বিরতিতে পাঁচটি কলস ফিনিয়াল দ্বারা শোভিত। এ সম্প্রসারিত অংশটিকে সমাধিসৌধ মনে করা হলেও সম্ভবত এটি ইমামের বসবাসের জন্যই প্রাথমিকভাবে নির্মিত হয়েছিল, কারণ এটি এখনও এ কাজেই ব্যবহূত হচ্ছে।

মসজিদ ভবনটির অলংকরণে এর স্থাপত্যিক বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বিশেষ করে প্রবেশপথগুলির পার্শ্ববর্তী অলংকৃত ক্ষুদ্র মিনার, অভিক্ষিপ্ত মিহরাব,ছত্রী, ছোট গম্বুজ এবং পদ্ম ও কলস শোভিত ফিনিয়াল। প্রবেশপথ ও মিহরাবগুলি ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত এবং এদের শীর্ষ মেরলোন শোভিত। প্যারাপেট ও গম্বুজ ড্রামের গায়েও রয়েছে উন্নত মেরলন মোটিফ। গম্বুজগুলির ভেতরের দিক পত্র নকশাকৃত এবং এদের শীর্ষবিন্দু বিশাল মেডালিয়নের মাঝে একটি রোসেট দ্বারা অলংকৃত। কেন্দ্রীয় খিলানপথটির অর্ধ-গম্বুজ ভল্ট মুকারনা নকশায় স্টাকো করা, যা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলি ছাড়া সমস্ত ভবনটি সাধারণ প্লাস্টার করা যা কিনা বাংলায় মুগল স্থাপত্যের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

মসজিদের বাওলি, যা একটি স্বতন্ত্র সৌধ হিসেবেই প্রতীয়মান, আলাদাভাবে উল্লেখ্যের দাবি রাখে। এটি বাংলায় একমাত্র ও স্বতন্ত্র নিদর্শন। এ ধরনের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় দাক্ষিণাত্যে, যেখানে এ মসজিদের নির্মাতা করতলব খান বাংলায় আসার পূর্বে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত করেছিলেন।  [এম.এ বারি]