কন্টি, নিকল দ্য

কন্টি, নিকল দ্য  ভেনিশিয়ান পরিব্রাজক। তিনি ভারত তথা বাংলার ওপর একটি নির্ভরযোগ্য বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি ভেনিসের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিকল দ্য কন্টি ১৪২৯ খ্রিস্টাব্দে বণিক হিসেবে দামেস্কে গমন করেন। সেখান থেকে তিনি আরও পূর্বে প্রাচ্যের দিকে যাত্রা করেন, যদিও তিনি তাঁর ভ্রমণ সাল সম্পর্কে কোনো তথ্য দেন নি। তিনি স্থলপথে পারসিয়া যান এবং সেখান থেকে মালাবার যাওয়ার জন্য একটি ধৌ (জাহাজ)-এ উঠেন। পরবর্তীতে তিনি বিজয়নগর রাজ্যে আসেন। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রী ও দু পুত্রকে নিয়ে সিলন, সুমাত্রা ও জাভার উদ্দেশ্যে নৌ-যাত্রা শুরু করেন ও দক্ষিণ চীনে পৌছেন এবং পরবর্তীকালে ইথিওপিয়ার উপকূল ধরে লোহিত সাগরের মধ্যে দিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর তিনি মরুভূমি পাড়ি দিয়ে কায়রো পৌঁছান। তাঁর স্ত্রী ও দু সন্তান কায়রোতে মারা যায়। তাদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।

নিকল তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্যই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস পৌঁছেন। পোপ চতুর্থ উজেন এর সেক্রেটারির কাছে তাঁর অভিযানের বর্ণনা দেওয়ার শর্তসাপেক্ষে তিনি পোপ এর কাছ থেকে ক্ষমা পান। পোপ এর সেক্রেটারি তাঁর এ বর্ণনা ল্যাটিন ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। ধারণা করা হয় যে, এটি লিসবন থেকে পর্তুগিজ ভাষায় মুদ্রিত হয় এবং এরপর এটি থেকেই এর ইটালিয়ান সংস্করণ বের হয়। ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে এর মূল ল্যাটিন সংস্করণ সমগ্র বই হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং এরপর ইংরেজি অনুবাদ সম্পন্ন হয়।

বিজয়নগরের ওপর কন্টির বিবরণকে গুরুত্বের দিক থেকে শীর্ষ স্থানে রাখা যায়। কন্টি এরপর করমন্ডল উপকূলের দিকে অগ্রসর হন এবং একটি উপকূলীয় শহরে পৌঁছেন, যাকে কন্টি বঙ্গপোসাগরের উপকূলবর্তী মালেপুর (মেইলাপুর) বলে অভিহিত করেছেন। এখানে তিনি একটি চার্চ দেখতে পান যেখানে সেন্ট টমাস-এর সমাধি রয়েছে। চার্চে নেস্টোরিয়ান (বিজ্ঞ) খ্রিস্টানগণ বসবাস ও প্রার্থনা করতেন। এরপর তিনি আর কাবিলা শহরে পৌঁছেন। এখানে মুক্তা পাওয়া যেত। তিনি বড় পাতা বহুল পালমিরা গাছের কথাও উল্লেখ করেছেন। কন্টি এরপর শ্রীলঙ্কা পৌঁছেন। সেখানে তিনি দারুচিনি দেখতে পান। শ্রীলঙ্কা ত্যাগ করে তিনি সুমাত্রা পৌঁছেন। এটি ছিল একটি উন্নত বাণিজ্যকেন্দ্র ও ছয় মাইল পরিধির ছোট শহর। সুমাত্রায় তিনি এক বছর সময়কাল অতিবাহিত করেন। সেখান থেকে বিশ দিন নৌযাত্রা শেষে তিনি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেন। আন্দামানের নর-নারী মূল্যবান পাথরের কানের দুল পরিধান করত, আর তাদের পরনে থাকত হাটু পর্যন্ত লম্বা সুতি ও রেশমের পোশাক এবং তারা ছিল পৌত্তলিক। তারা বাস করত নিচু করে নির্মিত ঘরে। এখানে গোলমরিচ, কর্পূর ও সোনা উৎপন্ন হতো। দ্বীপের অধিবাসীদের একাংশ নরমাংস ভক্ষণ করতো এবং শত্রুর মাথার খুলি সংরক্ষণ মূল্যবান সম্পদ হিসেবে গণ্য করতো।

সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কন্টি গঙ্গা নদীতে প্রবেশ করেন এবং তিনি একটি বড় ও সমৃদ্ধশালী শহর দেখেন, এ শহরকে তিনি সেরনোভা বলে অভিহিত করেন। এখানে নদী ছিল বিশাল, কোনো কোনো জায়গায় এর বিস্তৃতি ছিল পনেরো মাইলেরও অধিক। নদীর উভয় তীরে ছিল বাঁশ ঝাড় ও সে সাথে বাড়ি, ক্ষেত ও বাগান। গঙ্গার উজানে প্রায় তিন মাস নৌযাত্রা ও পথে চারটি বড় শহর অতিক্রম করে কন্টি একটি বড় শহরে পৌঁছেন যাকে তিনি মারজিয়া নামে উল্লেখ করেছেন। এখানে তিনি ঘৃত-কুমারী গাছ, স্বর্ণ, রৌপ্য, মূল্যবান পাথর ও মুক্তার প্রাচুর্য লক্ষ্য করেন। এখান থেকে তিনি পূর্বদিকের পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে যান এবং পুনরায় সেরনোভা শহরে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখান থেকে তিনি বুফেতানিয়া শহরের দিকে যাত্রা করেন এবং তারপর তিনি জাহাজ যোগে আরাকান পৌঁছেন। সেরনোভাকে অনেকে সোনারগাঁও ও বুফেতানিয়াকে চট্টগ্রামের সাথে শনাক্ত করে থাকেন। এরপর তিনি পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে মায়ানমারের ইরাবতী নদীর তীরে পৌঁছেন। মায়ানমারের ওপর তিনি একটি বিশদ বিবরণ রেখে গেছেন।

নিকল দ্য কন্টি এরপর পিকিং পৌঁছেন। তিনি একে কাম্বালা বলে অভিহিত করেন। এখানে তিনি চীনের বিখ্যাত প্রাচীর দেখেন। পেগুর মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করে তিনি কুইলন পৌঁছেন। শহরটির পরিধি ছিল বারো মাইল। এখানে তিনি অন্যান্য সাপের মধ্যে অজগর সাপ দেখেন। এরপর কন্টি কোচিন আসেন এবং সেখান থেকে কালিকট পৌঁছেন। কালিকট ছিল আট মাইল পরিধির একটি শহর। এখানে গোলমরিচ, আদা ও দারুচিনির প্রাচুর্য ছিল। কালিকটে কন্টি বহুভর্তৃকা প্রথা লক্ষ্য করেন এবং এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ রেখে গেছেন। ক্যাম্বি ভ্রমণের পর তিনি সোকোত্রা দ্বীপে যান এবং সেখান থেকে জেদ্দার উদ্দেশ্যে লোহিত সাগরে নৌযাত্রা শুরু করেন। সেখান থেকে ভেনিসে প্রত্যাবর্তন করেন।

কন্টির লেখা অসাধারণ গ্রন্থে পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে ভারত তথা বাংলা বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ও শিষ্টাচারের এক সমৃদ্ধময় দেশ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর উল্লিখিত শহরগুলি শনাক্তকরণে জটিলতার সৃষ্টি করেছে।  [অনিরুদ্ধ রায়]

গ্রন্থপঞ্জি  RH Major (ed.), India in the Fifteenth Century, New Delhi, 1994 reprint of 1857 ed; EF Oaten, European Travellers in India, Lucknow, 1973, reprint of 1909 ed।