ঔপনিবেশিক যুগ

ঔপনিবেশিক যুগ (১৭৫৭-১৯৪৭)  বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এদেশে এসে বাণিজ্য বসতি স্থাপন করে। আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে কোম্পানি বঙ্গের সর্বময় কর্তায় পরিণত হয়। বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজ্য স্থাপন ছিল সমকালীন ইউরোপীয় বেনেবাদ নীতির পরিপন্থি। উল্লেখ্য যে, সমকালীন ইউরোপীয়রা সাগরের ওপাড়ে গিয়ে জনমানবশূন্য বা আদিবাসী অধ্যূষিত এলাকা দখল করে স্ব স্ব জাতির পক্ষে উপনিবেশ স্থাপন করলেও বঙ্গদেশই প্রথম সভ্য দেশ যেখানে একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো।

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মতে, এ অভূতপূর্ব ঘটনা কোনো সচেতন পরিকল্পনার ফসল নয়। তাঁরা মনে করেন যে, বঙ্গদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঘটেছে পর্যায়ক্রমে এবং নানা অনভিপ্রেত ঘটনা প্রবাহের ফলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দলিলে দেখা যায় যে, কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স কোম্পানির বেঙ্গল কাউন্সিলকে সব সময়ই এখানে রাজ্য স্থাপণের ব্যাপারে নিরোৎসাহিত করেছে, কিন্তু তবুও কালে কোম্পানির বঙ্গরাজ্য প্রতিষ্টিত হলো। দেখা যায় যে, কর্তৃপক্ষের মতামতকে উপেক্ষা করে যখন কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যুদ্ধ বা জোরজবরদস্তির মাধ্যমে কোনো সুবিধা আদায় করতে পেরেছে, কোর্ট তা সবসময়ই অবলীলাক্রমে গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ কোর্ট কখনও ঝুঁকি নিতে চায় নি। তবে ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল ঝুঁকি নিয়ে সুবিধাজনক সাফল্য দেখাতে পারলে কোট অব ডাইরেক্টর্স তা সব সময়ই মেনে নিয়েছে। বাণিজ্যের সুবিধার্থে কোম্পানির স্থানীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে রাজ্য স্থাপনের অভিলাষ ক্রমশই দাঁনা বেধে উঠেছিল আঠারো শতকের প্রথম দশক থেকেই।

১৬৫১ সালে সুবাহ বাঙ্গালার সুবাহদার শাহ সুজার নিকট থেকে একটি নিশানের ওপর ভিত্তি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্ষিক নির্দিষ্ট তিন হাজার টাকা পরিশোধের শর্তে এ দেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য শুরু করে। বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার এ ব্যবস্থা শুধু কোম্পানির জন্য সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীসময়ে কোম্পানির কর্মকর্তারা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্যও এ সুবিধা বেআইনীভাবে ব্যবহার করার প্রয়াস পায়। এর ফলে সরকারের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্কে ক্রমশই অবনতি ঘটতে থাকে। এর এক পর্যায়ে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের এদেশ থেকে উচ্ছেদ করার জন্য কলকাতা আক্রমণ করেন। এ ঘটনা জন্ম দেয় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি যার শেষ ফল পলাশীর যুদ্ধ, বক্সারের যুদ্ধ এবং পরিশেষে ১৭৬৫ সালে দীউয়ানি লাভের মাধ্যমে সুবাহ বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য স্থাপন।

ঔপনিবেশিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা  বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের চূড়ান্ত পরাজয় কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করল। কোম্পানি নীতি গ্রহণ করল সরাসরি ক্ষমতা দখল না করে একজন নামেমাত্র নওয়াব গদিসীন রেখে প্রকৃত ক্ষমতা কোম্পানির হাতে তুলে নিয়ে দেশের রাজস্বের ওপর হিস্যা বসানো। এ নীতির অংশ হিসেবেই ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর রবার্ট ক্লাইভ সম্রাটের নিকট থেকে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার দীউয়ানি লাভ করেন (১৭৬৫)। সম্রাট ও নওয়াবের সঙ্গে চুক্তি হয় যে, দীউয়ান হিসেবে কোম্পানি সুবা বাংলার রাজস্ব সংগ্রহ করবে। চুক্তির শর্তানুসারে কোম্পানি সুবার রাজস্ব থেকে বার্ষিক থোক ছাবিবশ লক্ষ টাকা বাদশাহকে এবং তিপ্পান্ন লক্ষ টাকা নওয়াবকে প্রদান করবে এবং বাকি রাজস্ব কোম্পানি নিজে ভোগ করবে।

দীউয়ানি লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ না করে এ দায়িত্ব অর্পণ করল একজন নায়েব দীউয়ানের ওপর। নায়েব দীউয়ান হিসেবে নিযুক্ত হলেন চট্রগ্রামের প্রাক্তন ফৌজদার সৈয়দ মুহম্মদ  রেজা খান। নাবালক নওয়াব নজমুদ্দৌলার পক্ষে নিজামত প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বও প্রদান করা হয় রেজা খানকে।  অর্থাৎ ১৭৬৫ সালের ব্যবস্থায় দৃশ্যত রেজা খানই হলেন প্রশাসনের প্রথম ব্যক্তি। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে অলিখিতভাবে কোম্পানিরই অদৃশ্য হাতে।  দ্বৈত শাসন নামে এ ব্যবস্থায়  নায়েব নাজিমের ওপর সকল দায়িত্ব অর্পিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই, আর কোম্পানির কাছে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত, কিন্তু কোনো দায়িত্ব নেই। কোম্পানি সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ করলে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক ও ভারতীয় রাজন্যগোষ্ঠী তা মেনে নেবে না এ আশংকাবশতই ক্লাইভ কূটনৈতিক চাল দিয়ে দ্বৈত শাসনের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া, দেশ শাসনের জন্য তখন কোম্পানির না ছিল প্রয়োজনীয় লোকবল, না ছিল কোনো অভিজ্ঞতা। তবুও ক্লাইভ দীউয়ানি চুক্তি করেন দুটি প্রধান কারণে। একটি রাজনৈতিক। সিরাজউদ্দৌলা বা মীর কাসিমের মতো নওয়াবের যেন আর আবির্ভাব না হতে পারে তার ব্যবস্থা করা। অপর উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক। কোম্পানির প্রাচ্য বাণিজ্যের পুঁজি স্বদেশ থেকে না এনে প্রাচ্য থেকেই সংগ্রহ করা। ইতঃপূর্বে কোম্পানি এদেশে স্বর্ণরৌপ্য নিয়ে আসত পণ্য কেনার জন্য। কিন্তু আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে ব্রিটিশ সরকার বিদেশে ধাতব রপ্তানির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করতে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোম্পানি চেষ্টা চালায় প্রাচ্য বাণিজ্যের জন্য প্রাচ্যদেশ থেকেই পুঁজি সংগ্রহ করার। সুবাহ বাংলার দীউয়ানি লাভ ছিল এ নীতিরই একটি অংশ।

দীউয়ানির নামে বাংলায় কোম্পানি যে শোষণ ও উৎপীড়নের রাজ্য কায়েম করল তাতে ব্রিটিশ সরকার এতদিন কোনো ভ্রুক্ষেপ করে নি। ১৭৬৯/৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষ ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করল কোম্পানির বিষয়াদিতে হস্থক্ষেপ করার জন্য। ১৭৭২ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে পার্লামেন্ট কোম্পানির বঙ্গরাজ্য বিষয়ে প্রথম হস্তক্ষেপ করে। মার্কিন বিপ্লবের পর আমেরিকা থেকে বিতাড়িত হয়ে ব্রিটিশ সরকার বিকল্প কলোনি হিসেবে দৃষ্টিপাত করল ভারতের ওপর। পাস করল পিট-এর ভারত আইন (১৭৮৪) যার মাধ্যমে কোম্পানির বঙ্গ রাজ্যের ওপর ব্রিটিশ সরকারের কর্তৃত্ব আরও সুদৃঢ় করা হলো। লর্ড  কর্নওয়ালিসকে পার্লামেন্ট গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে এ নির্দেশ দিয়ে যে, তিনি একটি স্থায়ী ভূমি ব্যবস্থা ও দক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গরাজ্যকে একটি শক্তিশালী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত করবেন।

নির্দেশানুসারে কর্নওয়ালিস ত্বরিৎ গতিতে ভূমি ব্যবস্থা ও প্রশাসনে অনেক সংস্কার আনয়ন করেন।  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর মাধ্যমে তিনি একটি জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করেন। ভূমির একচ্ছত্র মালিক করা হয় জমিদারকে। জমিদারের ওপর সরকারের রাজস্ব দাবি চিরকালের জন্য স্থির করে দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে সমর্থন করে এমন একটি প্রভাবশালী অনুগত শ্রেণি সৃষ্টি করা। এর অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ভূমি নিয়ন্ত্রণে স্থিতিশিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে জমিদার শ্রেণির উদ্যোগে দেশের কৃষি অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলা। প্রশাসন, বিচার ও পুলিশ বিভাগকে ঢেলে সাজিয়ে কর্নওয়ালিস ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভিত মজবুত করে স্থাপন করেন। একটি উচ্চ বেতনভোগী পেশাগত আমলাতন্ত্র স্থাপন করে কর্নওয়ালিস ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন। যথার্থই বলা হয় যে, কোম্পানির বঙ্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ক্লাইভ ও হেস্টিংস এবং এর প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠাতা কর্নওয়ালিস।

তবে বঙ্গরাজ্য সম্পূর্ণভাবে কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত হলেও ব্রিটিশ সরকার প্রথম পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে ১৮১৩ সালে যখন পার্লামেন্ট একটি চার্টার অ্যাক্ট বলে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে এবং দেশের শাসনভার আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানির ওপর ন্যস্ত করে। উক্ত আইনে কোম্পানির দূরপ্রাচ্য বাণিজ্য বজায় রাখে। ১৮৩৩ সালের চার্টার আইনে তাও বিলুপ্ত করা হয়। এরপর থেকে কোম্পানির অধিকার থাকে পার্লামেন্টের পক্ষে শুধু ব্রিটিশ ভারত শাসন করার ক্ষেত্রে। ১৮৫৮ সালে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ ভারত শাসনের দায়িত্ব সরাসরি ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করে।

এমনিভাবে কোম্পানির বঙ্গ রাজ্য ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এমনকি প্রদেশরূপেও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ছিল বোম্বে ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির চেয়ে অনেক কম সুবিধাপ্রাপ্ত। উক্ত দুটি প্রদেশের জন্য পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন গভর্নর ও গভর্নর-এর কাউন্সিল ছিল। কিন্তু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জন্য না ছিল স্বতন্ত্র গভর্নর, না ছিল কোনো কাউন্সিল। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি শাসিত হতো পরোক্ষভাবে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক। গভর্নর জেনারেলের পক্ষে একজন কাউন্সিলর ডেপুটি গভর্নর উপাধি ধারণ করে নামে মাত্র বঙ্গীয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন। ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারতব্যাপী বিস্তারের ফলে প্রশাসন ও অর্থনীতির দিক থেকে বাংলা প্রদেশ সবচেয়ে অবহেলিত ও পশ্চাদপদ হয়ে পড়ল। ১৮৫৪ সাল থেকে বাংলার জন্য একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করা হলো, কিন্তু কোনো কাউন্সিল ছাড়া। সার্বিক অবস্থা আগের মতই করুণ থাকায় প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির নামে ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ করা হয়। কিন্তু এর বিপক্ষে রাজনৈতিক চাপের মুখে ১৯১২ সালে বঙ্গ বিভাগ রদ করা হয়।

কিন্তু যুক্ত বাংলা প্রশাসনিক দিক থেকে আগের পর্বে ফিরে যায় নি। বাংলাকে বোম্বে ও মাদ্রাজের মতো একটি গভর্নর শাসিত প্রদেশে পরিণত করা হয়। গভর্নরকে সাহায্য করার জন্য স্থাপিত হয় একটি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল। বাংলা প্রদেশের রাজধানী করা হয় কলকাতা এবং কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় দিল্লিতে।

বাংলা বিভাগকে পূর্ব বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় স্বাগত জানিয়েছিল। বঙ্গ বিভাগ রদ হওয়ার ফলে এ অঞ্চলের রাজনীতির ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া পড়ে। মুসলিম সম্প্রদায় ইংরেজদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং বিকল্প হিসেবে মুসলিম নেতৃবর্গের অনেকে কংগ্রেস মতাদর্শে ঝুঁকে পড়ে। অপরদিকে, মুসলমান নেতৃত্বের অনেকে ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে মুসলিম রাজনীতি শুরু করে। বস্ত্তত, ১৯২০ এর পর থেকে বঙ্গীয় রাজনীতি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে ঘিরেই আবর্তিত হয় এবং পরিশেষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্টে বাংলা বিভক্ত হয়।

হিন্দু-মুসলমান মৈত্রী স্থাপনে জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনেক সক্রীয় চেষ্টা সত্ত্বেও সে ঐক্য কার্যকরভাবে কখনও স্থাপিত হয় নি।  চিত্তরঞ্জন দাস এর নেতৃত্বে ১৯২৩ সালে  বেঙ্গল প্যাক্ট নামে যে চুক্তি হয়েছিল তা অকার্যকর হয়ে গেল ১৯২৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরপরই। এর পর প্রতিটি কাউন্সিল নির্বাচন হয়েছে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রেখে। ১৯৩৫ সালের ভারত আইন সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করার ফলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব আরও বেড়ে গেল। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে  মুসলিম লীগ বঙ্গীয় আইন সভায় দ্বিতীয় বৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপরই ছিল  কৃষক প্রজা পার্টি। দৃশ্যত অসাম্প্রদায়িক হলেও এ দলটিও ছিল মুসলিম রাজনীতি ঘেষা। অর্থাৎ উভয় দল মিলে সহজেই বঙ্গীয় আইন সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল এবং ক্রমাগত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মন্ত্রিসভা গঠন করতে সক্ষম হলো।

১৯৩৫ সালের ভারত আইন সাম্প্রদায়িক ও তফশিলি রাজনীতির জন্ম দেয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল মুসলিম ও তফশিলি রাজনীতির পক্ষে। সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতির বিজয় উপমহাদেশের রাজনীতির গতিাধারা বদলে দিল। ১৯৪০ সালের  লাহোর প্রস্তাব ছিল পরিবর্তিত রাজনৈতিক চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ। প্রথম স্বতন্ত্র নির্বাচন, তারপর স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। স্বাভাবিক কারণেই এ হেন অভাবিত পরিবর্তনকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস দল মেনে নিতে পারেনি। দেখা দিল অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্ব। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সালের ভারত ও বঙ্গ বিভাগ পর্যন্ত সময়কালটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য ক্রান্তিকাল। নানা বাস্তব পরিস্থিতি বাংলার মুসলিম নেতৃত্ব পাকিস্তান আদর্শকে মেনে নিল। এর প্রথম পরিণতি দেশ বিভাগ ও অজস্ত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা।

ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাত  পলাশীর পর পর্যায়ক্রমে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা বাংলায় তথা ভারতে দুটি সংস্কৃতির সম্মিলন সূচনা করল। বিগত পাঁচ শত বছর যাবং হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সংমিশ্রণে নির্মিত পারস্পরিক সহাবস্থান ভিত্তিক বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে এখন যুক্ত হল ইউরোপীয় সংস্কৃতি। কিন্তু পূর্বেকার মতো এবার স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ লক্ষণীয়ভাবে ঘটে নি। শাসক ইংরেজ জাতি প্রথম থেকে দেশে ইউরোপীয় শাসন ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করল। ভূমি প্রশাসনেও ইউরোপীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা-প্রশাসনও প্রবর্তিত হয় ইউরোপীয় আদলে। শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি এবং বিষয়ও ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক। অতএব, ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসে যা সকল সনাতন প্রথা,প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাকে অবক্ষয়িত করে তোলে।

ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সনাতন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন সূচিত হয় এর কতিপয় উপমা দেওয়া যেতে পারে। মুগল রাষ্ট্রের  সুবাহদার এর ক্ষমতা প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা ছিল। প্রথা, ঐতিহ্য, ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা বাধা ছিল তাঁর ক্ষমতা। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল পায় অপরিসীম ক্ষমতা, অন্তত বিশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত ভোগ করতেন। মুগল আমলে ছিল গ্রামপ্রধান, পঞ্চায়েত, কাজী, কানুনগো, আমিন, থানাদার, ফৌজদার প্রভৃতি স্থানীয় সরকারের স্থানীয় আমলাবর্গ। কিন্তু গভর্নর জেনারেলের স্থানীয় সরকার বলতে ছিল মাত্র জেলা কালেক্টর, জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। শত শত বর্গমাইল ব্যাপী একটি জেলা পরিচালিত হতো অসীম ক্ষমতাধারী ওই তিন সাহেব সিভিলিয়ন অফিসার দ্বারা। জেলা প্রশাসনে জেলার মানুষের কোনো হাত ছিল না। মুগল রাষ্ট্রে ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা ভাগাভাগী হতো হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী ছিল শুধু শ্বেতাঙ্গ শাসকশ্রেণী। আমলাতন্ত্রের কিছু অংশ দেশিদের ভাগে আসতে থাকে উনিশ শতকের শেষ নাগাদ। মুগল আমলে শিক্ষা ছিল সবার জন্য মুক্ত। টোল, পাঠশালা, মক্তব, মাদ্রাসায় যেন সবাই মুক্তভাবে এবং বিনা পয়সায় পড়াশুনা করতে পারে সে জন্য মুগল সরকার দিত নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় আর্থিক সুযোগ সুবিধা, যেমন বৃত্তি, মহাত্রাণ, মিল্লাকি ও ওয়াক্ফ। মদদ-ই মাশ নামে ওসব সুযোগ সুবিধা ব্রিটিশ আমলে প্রত্যাহার করা হয়। ব্রিটিশ আমলে শিক্ষা এত ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে দাড়ায় যে, একমাত্র ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেত না। যে জন্য ১৮৭২ সালের আদম শুমারিতে দেখা যায় যে, বাঙালিদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ছিল তখন মাত্র শতকরা চার ভাগ।

ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়েছে ভূমি সম্পর্ক ও গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারকে জমির একচ্ছত্র মালিক ঘোষণা এবং রায়তকে জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজায় পরিণত করে গ্রামীণ ভূমি নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কে নেতিবাচকভাবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করা হলো। ইতঃপূর্বে ভূমির মালিকানা ছিল সরকারের ওপর ন্যস্ত। সরকার ও রায়তের মধ্যে ছিল সরাসরি সম্পর্ক। সরকারের পক্ষ থেকে জমিদার রাজস্ব সংগ্রহ করত। জমিদার ছিল সরকারের স্থায়ী স্থানীয় কর্মকর্তা ও প্রতিনিধি। রায়তের খাজনার হার ছিল পরগণার নিরিখে নির্ধারিত। জমিদার তা ইচ্ছা করলেই সরকারের নির্দেশ ছাড়া পরিবর্তন করতে বা রায়তকে উৎখাত করতে পারত না। এক কথায়, তাত্ত্বিকভাবে ভূমির মালিক সরকার হলেও, বাস্তবে বংশাণুক্রমিকভাবে ভোগ দখলকার হিসেবে রায়তই ছিল জমির মালিক, আর জমিদার ছিল সরকারের পক্ষে খাজনা সংগ্রাহক মাত্র। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে এ সম্পর্ককে পাল্টে জমিদারকে করা হলো পাশ্চাত্য অর্থে জমির একচ্ছত্র মালিক আর রায়তকে পরিণত করা হলো তার ইচ্ছাধীন প্রজায়। এ সম্পর্কের অভিঘাতে পল্লী বাংলায় সৃষ্টি হলো সর্বময় ক্ষমতাধারী এক ভূস্বামী শ্রেণি। ভূস্বামী-প্রজা সম্পর্ক হয়ে উঠল শোষক-শোষিতের। গ্রামীণ সম্পদ ভূস্বামীর হাতে পুঞ্জিভূত হলো। প্রজা হলো এক চিরঋৃণগ্রস্থ এক অসহায় দুর্বল শ্রেণি। অর্থের অভাবে এরা শিক্ষাবঞ্চিত এবং স্বাভাবিকভাবেই পশ্চাদপদ। রাজনৈতিকভাবে এর তাৎপর্য এ যে, একচেটিয়া সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী জমিদার ছিল প্রায় সবাই হিন্দু, আর অধিকারহীন, সহায় সম্বলহীন প্রজাকুলের অধিকাংশ ছিল মুসলমান। এ সম্পর্কের মাপকাঠিতে হিন্দু মুসলমানের ক্রমাবনতিশীল সম্পর্ক ও পরিশেষে দেশ বিভাগের ইস্যুগুলি অনেকাংশে ব্যাখ্যা করা যায়।

ঔপনিবেশিক শাসনের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো যে, সচেতন এবং পরিকল্পিতভাবে দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে পাশ্চাত্যমুখী করা। পূর্ববর্তী কোনো শাসকগোষ্ঠী এমনতরো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করে নি। মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথা প্রতিষ্ঠানে কখনও হস্তক্ষেপ করার প্রয়াস পায় নি। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ধর্ম ছাড়া বাকি সব ব্যাপারে পাশ্চাত্য সভ্যতার অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। ভারতীয়দের ‘সভ্য’ করা ছিল ব্রিটিশদের একটি মিশন। ওই লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষা ব্যবস্থা ও নানা সংস্কার আইন প্রবর্তন করেছে।

ব্রিটিশদের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ছিল দেশে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এ লক্ষ্যে নানা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয় ১৮৬১ সাল থেকে। এ প্রকল্পে পাশ্চাত্যশিক্ষিত ভদ্রলোকেরা শুধু সমর্থন দেয় নি, বরঞ্চ এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষার বাইরের জনতা এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ প্রদর্শন করে নি। তারা তাদের সনাতন পঞ্চায়েত ও সালিশ ব্যবস্থাকেই অাঁকড়ে থেকেছে। অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে প্রাচ্য ব্যবস্থার পরিবর্তে পাশ্চাত্য ব্যবস্থা প্রবর্তন করার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তত্ত্ব দেওয়া হয়েছিল যে, পাশ্চাত্য শিক্ষা দেশের মানুষকে পাশ্চাত্য ব্যবস্থাদির প্রতি আকৃষ্ট করবে এ তত্ত্ব পরে সঠিক প্রমাণিত হলো।  [সিরাজুল ইসলাম]