এ্যানথ্রাক্স

এ্যানথ্রাক্স (Anthrax)  Bacillus Anthracis ব্যাকটেরিয়াঘটিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। গ্রীক শব্দ এ্যানথ্রাক্স-এর অর্থ Coal বা কয়লা। এ রোগের কারণে শরীরে কালো রঙের ক্ষত সৃষ্টি হয় বলেই এর এই নামকরণ। বাংলায় একে তড়কা রোগ বলা হয়। এতে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি গৃহপালিত প্রাণি আক্রান্ত হতে পারে। এটি ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু বাহিত রোগ। এ জীবাণুর মূল উৎস মাটি। দীর্ঘদিন (অন্তত ৩/৪ দশক) রড আকৃতির এই জীবাণু স্পোর মাটিতে টিকে থাকতে পারে। গবাদিপশু বা কোনো তৃণভোজী প্রাণি মাটি থেকে ঘাস খাবার সময় সহজেই এ রোগের জীবাণু (Spore) দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগের জীবাণু সংক্রমিত পানি পান করলেও গবাদিপশু এ্যানথ্রাক্স দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। প্রাণি থেকে এ রোগ মানুষেও ছড়ায়। এটি জোনোটিক (zoonotic) রোগ।  তবে মানুষ থেকে মানুষে এ রোগের বিস্তার ঘটেনা।

গবাদিপশুর একটি প্রাচীন সংক্রামক রোগ এ্যানথ্রাক্স। গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত হলে গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। শরীরের তাপমাত্রা ১০৪º ফা. এর চেয়েও অধিক হয়। তাতে হঠাৎ করেই গরু পড়ে যায়। মাত্র কয়েক ঘন্টা কিংবা কয়েক দিনের মধ্যেই গরু মরে যেতে পারে। তার আগে নাক, মুখ দিয়ে কিংবা পায়খানা-প্রস্রা্বের সংগে কালো রঙের রক্ত বের হতে পারে। মৃত গরুর শরীরে দ্রুত প্রচন ধরে এবং পেট ফুলে যায়। আক্রান্তপশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং মাংস কাটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ এ রোগের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মানব দেহে কাটা ছেড়ার মাধ্যমে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অথবা খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পশুর হাড়চূর্ণ কিংবা চামড়া দ্বারাও এ রোগ ছড়াতে পারে। তবে দুধ থেকে এ রোগ ছড়ায় না।

মানুষের শরীরে প্রধানত ৩ ধরনের এ্যানথ্রাক্স-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হলো, ত্বক সংক্রান্ত এ্যানথ্রাক্স,  শ্বাসজনিত এ্যানথ্রাক্স এবং পরিপাকতন্ত্রের এ্যানথ্রাক্স। সাধারণত ত্বকের এ্যানথ্রাক্স সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। তাতে হাত ও পায়ের ত্বকে কালো রঙের ক্ষত সৃষ্টি হয়। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে তা সারা দেহেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিছুদিন পর আক্রান্ত  স্থান ফুলে যায় এবং তাতে ভীষণ ব্যথা অনুভুত হয়। মানব দেহ এ্যানথ্রাক্স সংক্রমিত হলে ৮/১০ দিনের মধ্যেই তা প্রকাশ পায়। তবে চিকিৎসা নিলে তা নিরাময় হয়ে যায়।

গবাদিপশু এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে এর চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয় এন্টিবায়োটিক। মাংসপেশিতে দেয়া হয় পেনিসিলিন ইনজেকশন। শিরায় ক্রিস্টালিন পেনিসিলিন ইনজেকশন দিয়েও রোগের উপশম করা যায়। ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ক্লোফেনাক জাতীয় ঔষধ। আর রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভেকসিন। এর জন্য প্রাণি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পশুপাখীর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। এ গুরুত্ব স্থূল জাতীয় আয়ে এর উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র বিমোচনের জন্যে এবং আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্যে। এ দেশে মানুষের ঘনত্ব যেমন বেশি, পশুপাখীর ঘনত্বও বেশি। কিন্তু উৎপাদন ক্ষমতা কম। উন্নত দেশগুলো থেকেতো বটেই, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়েও এ দেশে পশুপাখীর উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কম। এর কারণ অনেক। একটি প্রধান কারণ হলো ঘন ঘন রোগের প্রাদুর্ভাব। আবহাওয়াগত কারণে এখানে পশুপাখীর রোগ হয় বেশি। তাতে মৃত্যুজনিত কারণে ও অসুস্থতা হেতু উৎপাদন হ্রাসের ফলে এ উপখাতের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। কারো কারো মতে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রতিবছর প্রায় ২৫ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে। চলতি মূল্য প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা। গত দুবছর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে দেশে যে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ভয়ানক প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল তাতে মোট ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালে দেখা দেয় গবাদিপশুর এ্যানথ্রাক্স রোগ। দ্রুত এ রোগটি ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। তাতে এ উপখাত থেকে অর্জিত জিডিপির প্রায় তিন চতুর্থাংশ আয় ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।

এ্যানথ্রাক্স গবাদিপশুর একটি ভয়ানক রোগ। এর জীবাণু মানুষের জন্য সমরাস্ত্র হিসেবেও ব্যবহূত হয়। বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকা ও রাশিয়া এ রোগের জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ইরাক যুদ্ধের সময় চিঠির এনভেলপে করে এ্যানথ্রাক্স জীবাণু প্রেরণ করা হয়েছে আমেরিকায়। তাতে অনেকে রোগাক্রান্ত হয়েছে। ধারণা করা হয়, জঙ্গীবাদের সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসীরাও এ্যানথ্রাক্স ব্যবহার করতে পারে জীবাণু অস্ত্র হিসেবে।

২০১০ সালের আগস্ট মাসের মধ্যভাগে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি ও কামারখন্দ উপজেলায় এ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায় এবং পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি জেলায় তা ছড়িয়ে পড়ে। তাতে অসংখ্য গবাদিপশু এ রোগের জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অনেক পশু মারা যায়। অনেক মানুষের মাঝেও এ রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে সারা দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্তহয়। মাংসের ভোগ কমে যায়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দেয় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া। শহরে কি গ্রামে কেউ গরু কিংবা ছাগল-ভেড়ার মাংস সহজে কিনতে চায়নি। দ্রুত হ্রাস পায় চামড়ার উৎপাদন। তাতে চামড়া রপ্তানি বিপুল পরিমাণে কমে যাবার আশংকা দেখা দেয়। হালাল মাংস রপ্তানিও হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হয়। সেই সঙ্গে চামড়ার জুতা, হাড়ের চূর্ণ ইত্যাদির ব্যবহার ও রপ্তানি সংকুচিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। ফলে নিরুৎসাহিত হয় গবাদিপশুর খামার। তাতে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বিঘ্নিত হয়। এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সামগ্রিকত অর্থনীতির উপর। এমতাবস্থায় যাতে রোগটি ছড়াতে না পারে তার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন পরে। মানুষকে আতংকগ্রস্ত না হয়ে এ রোগের দমন ও প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন হতে পরামর্শ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে করণীয়গুলো নিম্নরূপ:

  • আক্রান্তপশুর মৃতদেহ, রক্ত ও মলমূত্র কমপক্ষে ৬ ফুট গভীর গর্ত করে চুন দিয়ে মাটিচাপা দিতে হবে। বর্জ্য উত্তমরুপে পরিস্কার করে ওই স্থানে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • আক্রান্ত পশুকে আলাদা করে রাখতে হবে।
  • এ রোগের সন্ধান পেলে দ্রুত প্রাণিসম্পদ অফিসকে খবর দিতে হবে এবং আক্রান্তপশুর চিকিৎসা করতে হবে।
  • সুস্থ গবাদিপশুকে এ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা দিতে হবে।
  • আক্রান্ত এলাকায় পশুর চালাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  • সংক্রামিত এলাকায় পশুচারণ বন্ধ করতে হবে এবং ওই এলাকা থেকে ঘাস কেটে গরুকে খাওয়ানো বারণ করতে হবে।
  • গবাদিপশু জবাই, মাংস কাটা ও রান্নার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মুখে মাক্স ও হাতে গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।
  • উচ্চ তাপমাত্রায় বিশেষ করে প্রেসার কুকারে ভালভাবে মাংস রান্না করে খেতে হবে।
  • মানুষের এ রোগ হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে চিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসায় এ রোগ নিরাময় হয়।

মানব কল্যাণের লক্ষ্যে এ রোগের উৎপত্তি, বিস্তার এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক ও আন্তশৃঙ্খলা ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার কাজ সম্পন্ন করা দরকার এবং জনস্বার্থে তা সবাইকে অবহিত করা উচিৎ। দু’বছর আগে ২০০৮ সালে এ ধরণের একটি গবেষণার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ওপর। দেশের ৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৭জন গবেষক এ কাজে অংশ নেন। অতি অল্প খরচে মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই গবেষণার কাজটি সম্পন্ন হয়। দেশে ও বিদেশে ওই কাজটি বেশ সমাদৃত হয়। এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে সাভারস্থ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে। বিভিন্ন জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে এর সারসংক্ষেপ। তা অনুসরণ করা যেতে পারে।

[জাহাঙ্গীর আলম]