এলিস কমিশন রিপোর্ট

এলিস কমিশন রিপোর্ট ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির রিপোর্ট। পূর্ববাংলা সরকার ১৯৫২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা হাইকোর্টের একজন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে ‘ঢাকা গেজেট’ এক্সট্রা অর্ডিনারি সংখ্যা প্রকাশ করে। উক্ত গেজেট নোটিফিকেশনে প্রধান বিচারপতিকে একজন তদন্তকারী বিচারক নিযুক্ত করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। প্রধান বিচারপতি তখনকার ঢাকা হাইকোর্টের অন্যতম বিচারপতি টি এইচ এলিসকে ঘটনা তদন্তের জন্য মনোনীত করেন এবং ১৭ মার্চ পূর্ববাংলার গভর্নর বিচারপতি এলিসকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপত্র দেন। ১৯৫২ সালের ২৭ মে কমিশন পূর্ববাংলার মুখ্য সচিবের নিকট রিপোর্ট পেশ করে।

এলিস কমিশনের তদন্তের আওতা ও বিবেচ্য বিষয় ছিল- ঢাকার সাম্প্রতিক ঘটনায় পুলিশের গুলিবর্ষণের কোনো প্রয়োজন ছিল কি না; ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় পুলিশের এ রকম শক্তি প্রয়োগ যুক্তিযুক্ত ছিল কিনা অথবা আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পক্ষে তা প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হয়েছিল কিনা।

বিচারপতি এলিস ২০ মার্চ পত্র-পত্রিকায় ও রেডিওতে একটি ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ প্রচার করে জনসাধারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য, ছাত্র অথবা ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে এবং প্রাদেশিক সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পক্ষ হতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় পুলিশের গুলি চালনার সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্যাবলি সম্পর্কে ৩১ মার্চ, ১৯৫২ তারিখের মধ্যে লিখিত বক্তব্য আহবান করেন। এ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে মোট ২৮টি লিখিত বক্তব্য পাওয়া যায়।

ঢাকায় কমিশনার্স কোর্টে এলিস কমিশন ১৯৫২ সালের ৮ এপ্রিল তদন্ত শুরু করে। কমিশন লিখিত বক্তব্য প্রদানকারী সাক্ষীগণকে দু’ভাগে ভাগ করে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। প্রথমভাগে ছিলেন যারা ২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণকে যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন এবং দ্বিতীয়ভাগে ছিলেন যারা এটাকে বাড়াবাড়ি মনে করেছেন।

এলিস কমিশনের রিপোর্টে ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশের গুলিবর্ষণের পূর্বে ঢাকা শহরের অবস্থা, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কার্যক্রম, জেলা প্রশাসন কর্তৃক ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির পটভূমি, ঘটনার দিন ছাত্র-জনতার ভূমিকা এবং গ্রেফতারসহ পুলিশী তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ রিপোর্টে প্রদান করা হয়েছে।

১৯৫২ সালের ২৭ মে বিচারপতি এলিস রিপোর্টটি পূর্ববাংলা সরকারের চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের নিকট পেশ করেন। ১৯৫২ সালের ৩১ মে তারিখে রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। চীফ সেক্রেটারি ৩ জুন তারিখে রিপোর্টটি পূর্ববাংলা সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করেন। এলিস কমিশন যে সিদ্ধান্ত প্রদান করে সেগুলি হলো- ক. পুলিশ কর্তৃক গুলিবর্ষণ প্রয়োজন ছিল; খ. ঘটনার বাস্তবতার কারণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগ যুক্তিযুক্ত ছিল।

বিচারপতি এলিসকে দেওয়া তদন্ত পরিধি ও আওতায় পরিচালিত এ তদন্ত কমিশনের রিপোর্টটি সে সময়ের রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন প্রত্যাখ্যান করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে জনসাধারণের মধ্য থেকে ২ জন বিশ্বাসভাজন প্রতিনিধি রাখার দাবি করলেও তা রাখা হয়নি। অন্যদিকে, তদন্ত কমিশনের কার্যক্রম ২১ তারিখের গুলিবর্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়; ২২ তারিখের ঘটনা তদন্তের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তদন্ত প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানের পরিবর্তে গোপনে করা হয় এবং তদন্তের স্বার্থে রাষ্ট্রভাষা কমিটির সদস্য, এম.এল.এ এবং অন্যান্য গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। তদন্ত কমিশনের রিপোর্টের সীমাবদ্ধতার কারণে এলিস কমিশনের রিপোর্টটি সমালোচিত হয়। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায়ও এ রিপোর্টের বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে।  [দেলওয়ার হাসান]