ঋণ সালিশি বোর্ড

ঋণ সালিশি বোর্ড  বিশ শতকের তিরিশের দশকের প্রথমদিকে অনানুষ্ঠানিক গ্রামীণ ঋণবাজার ভেঙে পড়ায় এবং এর ফলে সৃষ্ট বাংলার গ্রামীণ সমাজের ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঠেকাতে একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। ১৯৩৬ সালে বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরস অ্যাক্ট (১৯৩৬-এর বেঙ্গল অ্যাক্ট ৭)-এর অধীনে ঋণ সালিশি বোর্ড স্থাপিত হয়। এ আইন প্রণীত হওয়ার পূর্বে ঋণদাতাদের অর্থাৎ প্রধানত জমির মালিক, জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছিল। ১৯৩০-এর অর্থনৈতিক মহামন্দা বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কৃষিজাত পণ্যের বাজারমূল্য উৎপাদন ব্যয়ের অনেক নিচে নেমে যায়। হাতে কোনো নগদ টাকা না থাকাতে কৃষককুল তাদের জমিদারদের খাজনা প্রদানে এবং চাষবাস অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ ক্রয়ে ব্যর্থ হয়। প্রথাগতভাবে, গ্রামীণ ঋণের সরবরাহ আসত মহাজনদের কাছ থেকে এবং তাদের দেওয়া অধিকাংশ ঋণই ছিল বন্ধকের বিপরীতে। মন্দার কারণে ঋণ পরিশোধ একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার বন্ধকী ভূমি ঋণদাতার কাছে তামাদি হতে থাকায় সুদের পরিমাণও চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। এভাবে বিপুল পরিমাণ জমি অকৃষক মালিকানায় চলে যায়।

ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, গ্রামীণ ঋণগ্রস্ততা ও ভূমিহীনতার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব ফেলে। এদিকে আবার ঋণগ্রহীতারা ছিল প্রধানত মুসলমান এবং ঋণদাতারা হিন্দু। বেশির ভাগ হিন্দু জমিদার, তালুকদার ও জোতদারেরা ছিল মহাজন। গ্রামের ঋণগ্রস্ততা ও ভূমিহীনতা এভাবে শ্রেণিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের প্রধান হেতু হয়ে ওঠে। এসব ঘটনা ভালোভাবে বুঝতে এবং সমস্যার সমাধান খুঁজতে সরকার বোর্ড অব ইকোনমিক ইনকোয়ারি কমিটি গঠন করে। ভূমি সম্পর্কীয় সমস্যার বিচার-বিশ্লেষণ করে এই বোর্ড ক্রমবর্ধমান গ্রামীণ ঋণগ্রস্ততা এবং অকৃষক-শ্রেণির কাছে কৃষকদের জমি হস্তান্তরের ব্যাপার নিয়ে কিছু কার্যক্রমের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে। ঋণ-সংক্রান্ত বিষয়ে কমিটি আরও একটি খসড়া বিল (বেঙ্গল রিলিফ অব ইনডেটেডনেস বিল) লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের বিবেচনার জন্য তৈরি করে।

বোর্ড অব ইকোনমিক ইনকোয়ারি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৩৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গীয় আইন পরিষদে খাজা নাজিমউদ্দীন একটি বিল উত্থাপন করেন। বিলটি বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরস অ্যাক্ট (১৯৩৬-এর বেঙ্গল অ্যাক্ট ৭) শিরোনামে ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে আইন পরিষদে পাস হয়। এ আইনের অধীনে ঋণ সালিশি বোর্ড স্থাপিত হয়। আইনটি ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়ের দ্বারা মনোনীত স্থানীয় প্রভাবশালী ও শিক্ষিত লোকদের মধ্য থেকে সদস্য নিয়ে ‘বোর্ড’ নামক ঋণবিষয়ক বেশ কয়টি সালিশি সভা স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেয়। বোর্ডের দায়িত্ব ছিল দু পক্ষেরই কথা শুনে প্রধানত মহাজনদের কাছে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের অনাদায়ী ঋণ আনুপাতিক হারে কমানো এবং এভাবে তাদের ওপর থেকে চাপ লাঘব করা। ঋণগ্রস্ত কৃষককুলকে সাহায্য করার অন্য উপায়গুলি ছিল একজন ঋণগ্রহীতাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা এবং এভাবে তাকে ঋণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া, সর্বাধিক বিশটি শুনানির মাধ্যমে আনুপাতিক হারে কমানো ঋণ সহজ কিস্তিতে পরিশোধ করা, দেওয়ানি আদালতের ডিক্রি ও সার্টিফিকেট-এর কার্যকারিতা বন্ধ করা ইত্যাদি।

১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে ঋণ সালিশি বোর্ডের কাজ পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। এ আইন বলবৎ হওয়ায় ঋণগ্রস্ত কৃষক ও ঋণদাতা মহাজন উভয়ে উপকৃত হয়েছিল বলে মনে হয়, যদিও সরকারবিরোধী জননেতাদের মধ্যে বোর্ডের কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। যেসব জায়গায় কৃষক সংগঠনগুলি শক্তিশালী ছিল, সেখানে দেনাদাররা ঋণ মওকুফের জন্য বোর্ডের কাছ যেতে খুব কমই আগ্রহী ছিল। কৃষকেরা সেখানেই ঋণ সালিশি বোর্ডের ব্যাপারে উৎসাহী ছিল যেখানে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ছিল দুর্বল।

এসব ঋণ সালিশি ক্রিয়াকলাপ প্রথাগত গ্রামীণ ঋণবাজারকে গুরুতরভাবে দুর্বল করে দেয়। মহাজনেরা তাদের গ্রামীণ ঋণদান ব্যবস্থা গুটিয়ে ফেলতে শুরু করলে ঋণদান সঙ্কুচিত হয়। ঋণ না পাওয়াতে চাষের অধীন ভূমির পরিমাণ অভূতপূর্বভাবে কমে যায়। অনেকের মতে, ঋণ সালিশি বোর্ড চালু হওয়া ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের একটি কারণ। মহাজনি ঋণ উঠে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট গ্রামীণ ঋণদানের সংকোচন আবাদি জমির পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে খাদ্য সরবরাহও কমে যায়। তবুও ভালো-মন্দ নিয়ে বোর্ড ১৯৪৪ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল, এবং এরপর এর বিলুপ্তি ঘটে। বোর্ডটি প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের জন্য স্থাপিত হয়েছিল এবং পরে এর কার্যকাল আরও দু বছরের জন্য বাড়ানো হয়। ঋণ সালিশি বোর্ড সত্যিকারভাবে বাংলার ঋণগ্রস্ত কৃষক সমাজের অবস্থার উন্নতি সাধন করতে পেরেছিল কি-না তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে একটি সাধারণ ধারণা চালু আছে, এটি বাংলার ঋণগ্রস্ত কৃষক সমাজকে রক্ষা করেছিল।

[সিরাজুল ইসলাম]