উন্নয়ন অর্থসংস্থান

উন্নয়ন অর্থসংস্থান  উন্নয়ন অর্থনীতির বিশেষ শাখা হিসেবে উন্নয়ন অর্থসংস্থান বর্তমানে নীতি-নির্ধারণ ও পরিকল্পনায় নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়োজিত সকল মহল, আমলা ও প্রশাসকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উন্নয়ন অর্থসংস্থানের আওতায় পড়ে সম্পদের পরিকল্পনা ও আবণ্টন, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ও বিনিয়োগ কৌশল বাছাই, দেশিয় ও বিদেশি উৎস থেকে পাওয়া অর্থসম্পদের ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য অর্থায়ন এবং লেনদেন ভারসাম্য ও আন্তর্জাতিক মুদ্রানীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়। বাংলাদেশে উন্নয়ন অর্থসংস্থান-এর কর্মতৎপরতা মূলত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে দেশে প্রতিবছর দুটি বাজেট প্রণয়নের রীতি চলে আসছে: একটি রাজস্ব বাজেট, অপরটি উন্নয়ন বাজেট। রাজস্ব বাজেটে দেশের সকল খাতে নিয়মিত কর্মকাণ্ডভিত্তিক আয়-ব্যয়ের হিসাব থাকে আর উন্নয়ন বাজেটে নির্দিষ্ট বছরে দেশে যেসব নতুন উন্নয়ন প্রকল্প/কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে সেগুলি এবং চালু প্রকল্প/কার্যক্রমসমূহে খাতওয়ারী আর্থিক বরাদ্দ ও কোথা থেকে এসব ব্যয় নির্বাহ করা হবে তার বিবরণ থাকে।

১৯৯০-এর পূর্বে দেশের রাজস্ব বাজেটে কখনও উন্নয়ন বাজেটের অর্থ যোগানোর মতো কোনো উদ্বৃত্ত পাওয়া যায় নি। ফলে উন্নয়ন বাজেটের সম্পূর্ণটাই ছিল বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর। দেশের কর ব্যবস্থা দুর্বল থাকার কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্জিত রাজস্ব ছিল খুবই কম এবং সে কারণেই দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নের ব্যয় মেটানোর জন্যে দেশে নিজস্ব অর্থ সংগ্রহের সমস্যা ছিল প্রকট। বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি কয়েকটি সমস্যা হলো সীমিত করভিত্তি, কর স্থিতিস্থাপকতার নিম্নহার এবং দুর্বল কর প্রশাসন। বিভিন্ন রকম কর অব্যহতির সুবাদে দেশের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, উদ্যোক্তাগণ রাজস্বক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনার যথেচ্ছ ব্যাখ্যা প্রয়োগ করে সেসবের বাড়তি সুবিধা ভোগ করে। এ সমস্যা ছাড়াও সাধারণভাবে করনীতি বৈষম্যমূলক এবং অধিক আয়ের জনগোষ্ঠীই এর বেশি সুবিধা নিতে সক্ষম। ফলে সরকার ব্যাপক পরিমাণ কর-আয় থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের মোট কর-আয়ের চার-পঞ্চমাংশই আসে পণ্য ও সেবার ওপরে পরোক্ষ কর হিসেবে। এর মধ্যে আবার বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পণ্য ও সেবা, বহিঃশুল্ক ও বিক্রয় কর (মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট)-এর পরিমাণই সিংহভাগ আর জাতীয় কর-আয়ের মোট পরিমাণের প্রায় অর্ধেকই আসে বিদেশি সাহায্যের অর্থ থেকে। তবে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হারে বৃদ্ধি পেলেও শুল্কযোগ্য আমদানির পরিমাণ প্রায় একই থাকায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যহ্রাস ঘটায় বিদেশি সাহায্যভিত্তিক এ জাতীয় কর-আয়ের পরিমাণ সময়ের ব্যবধানে তেমন বেশি বৃদ্ধি পায় নি।

দেশের কর-রাজস্বের এক-পঞ্চমাংশ আসে আয়কর হিসেবে। এক হিসাব অনুযায়ী আয়কর দেওয়া উচিত এমন লোকদের অর্ধেকেরও বেশি আয়কর রিটার্ন জমা দেয় না, কখনও আয়কর পরিশোধও করে না। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারের খারাপ অবস্থানের আরেক কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহের খারাপ আর্থিক পরিস্থিতি। এগুলির বৃহদাংশই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মুনাফা জমা দেওয়ার বদলে নিজেদের লোকসান মেটানোর জন্যে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে থাকে। জাতীয় সঞ্চয় স্কিম, ডাকঘর সঞ্চয় আমানত, ডাকঘর জীবনবীমা স্কিম, সরকারি কর্মচারিদের ভবিষ্য তহবিল, স্থানীয় ফান্ড এবং সরকারি বিভিন্ন বিভাগে আমানত জমা থেকে যে নীট মূলধন তৈরি হয় তা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানের সংকুলান হয় না।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থসংস্থানের ধারা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রা কোনো বছরেই অর্জিত হয় না। পক্ষান্তরে, প্রকৃত রাজস্ব ব্যয় ঘটে পরিকল্পিত ব্যয় অপেক্ষা বেশি। এর বিপরীত একটি ধারা তৈরি করে উন্নয়ন অর্থসংস্থানের জন্য অধিক হারে অভ্যন্তরীণ উৎসের তহবিল জোটাতে হলে প্রয়োজন অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন করা এবং শিল্প, সেবা, নির্মাণ, গৃহায়ণ, ব্যবসায় ও অন্যান্য সব খাত থেকেই অধিকতর পরিমাণে কর প্রাপ্তি। অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে লোকসান ঠেকানো, অনুৎপাদনশীল রাজস্ব ব্যয় কমানো, এবং অর্থনৈতিক তৎপরতাসমূহের এমন ব্যবস্থাপনা যাতে জনগণের আয়প্রবাহ সুষম হয় এবং কর প্রদানের উপযুক্ত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে তা পরিশোধ করে।

উন্নয়ন অর্থসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য দেশের বাণিজ্য ও সঞ্চয় ব্যবধান (trade and savings gap) পূরণ করে এবং যন্ত্রসরঞ্জাম, শিল্পকারখানার কাঁচামাল, জ্বালানি ও কারিগরি প্রযুক্তি আমদানির ব্যয় মেটায়। বিদেশি সাহায্য দেশিয় সম্পদসমূহের সুষ্ঠু বা অধিকতর উপযোগিতামূলক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখে। উন্নয়ন অর্থসংস্থানে বিদেশি সাহায্যের ওপর বাংলাদেশের ব্যাপক নির্ভরশীলতার দীর্ঘকালীন ধারায় সম্প্রতি কিছু পরিবর্তন এসেছে। কয়েক বছর ধরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থসংস্থানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পাওয়া অর্থের ভাগ কিছু কিছু করে বাড়ছে এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে এ ভাগের পরিমাণ ছিল উন্নয়ন খাতে দেশের মোট পরিকল্পিত ব্যয় বরাদ্দের ৫০.৫%। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে দেশের বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্ধে অভ্যন্তরীণ উৎসের অবদান অপেক্ষাকৃত কম (৪২%) হলেও ২০০৮-২০০৯ এবং ২০১০-২০১১ অর্থবছরে এই অনুপাতটি ছিল যথাক্রমে ৫৮% এবং ৫১%।

২০২০-২০২১ অর্থ বছরের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দ ছিল ২০৫,১৪৫ কোটি টাকা (বিবিএস, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, ১৯ মে ২০২০) এবং পরবর্তী ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে এই বরাদ্দ ছিল ২৩৬,৭৯৩ কোটি টাকা (দৈনিক জনকন্ঠ, ১৯মে ২০২১)। ২০২০-২০২১ সালের মোট বরাদ্দের ৬৫.৬৩ শতাংশ পাওয়ার হিসাব ছিল অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আর অভ্যন্তরীণ উৎসের এই হিসাব ২০২১-২০২২ এর জন্য ছিল ৫৮ শতাংশ। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ উন্নয়নখাতে যা ব্যয় করে থাকে তা উন্নয়ন অর্থসংস্থানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এসকল প্রতিষ্ঠানের এই খাতে বরাদ্দও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাজেটে সংযুক্ত হয়ে থাকে। ২০২১-২০২২ এর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অর্থায়নের উৎসসমূহের কাঠামো ছিল এরুপ: স্থানীয়/অভ্যন্তরীণ উৎস ৫৮%, বৈদেশিক উৎস ৩৭% এবং স্বায়ত্তশাসিক প্রতিষ্ঠান/সেক্টর কর্পোরেশন ৫%। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দের খাতওয়ারি বিভাজন ছিল পরিবহন ও যোগাযোগ ২৭.৩৫%, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি ২০.৩৬%, আবাসন ও কমিউনিটি পরিষেবা ১০.৫৪%, শিক্ষা ৭.৬৪, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ৬.৩৪%, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন ৩.৭৮%, কৃষি ৩.৪%, শিল্প ও অর্থনৈতিক পরিষেবা ২.০৬% এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ১.৫৯%।

১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশ মোট যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছিল তাতে খাদ্য সাহায্যের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি এবং পরিমাণগতভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল যথাক্রমে পণ্য ও প্রকল্প সাহায্য। এ কাঠামো সে সময় দেশের ভোগ্যপণ্য চাহিদা মেটাতে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অধিকতর নির্ভরশীলতারই পরিচায়ক। বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের এ কাঠামো পরিবর্তনে দাতা দেশ ও সংস্থাসমূহেরও তেমন কিছু করার ছিল না। তবে ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ১৯৭১-৯০ সালে বাংলাদেশ মোট যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে তার ২১.৪% ছিল খাদ্য সাহায্য, ৩১.৮% ছিল পণ্য সাহায্য এবং ৪৩.৮% ছিল প্রকল্প সাহায্য। পক্ষান্তরে, ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশ মোট যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পায় তার ৮৪% ছিল প্রকল্প সাহায্য, ১২% ছিল পণ্য সাহায্য এবং মাত্র ৪% ছিল খাদ্য সাহায্য। জুন ২০০৯-এ সমাপ্ত অর্থবছরে দেশে আসা মোট বৈদেশিক সাহায্যের ৯৭% ছিল প্রকল্প সাহায্য। অর্থাৎ বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগই বাংলাদেশ এখন ব্যয় করে উন্নয়ন চাহিদা পূরণে। প্রকল্প সাহায্যের প্রায় সম্পূর্ণটা উন্নয়ন অর্থসংস্থান এবং পণ্য সাহায্যেরও দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় শিল্প ও কৃষির উন্নয়ন তৎপরতামূলক কর্মকাণ্ডে খাদ্য সাহায্যেরও উল্লেখযোগ্য অংশ কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খাল খনন, পল্লী রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প, স্থানীয় উদ্যোগ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে ব্যয় হয়। পণ্য ও খাদ্য সাহায্যের বরাদ্দের বিনিময়ে জমা টাকা-তহবিলও উন্নয়নের কাজেই ব্যয় হয়।

বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বহুলাংশেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলির ভিত্তিতে প্রণীত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ কারণে দারিদ্র্য বিমোচন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ উন্নয়ন অর্থসংস্থানের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সফলতার ওপর। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেসব সমস্যা প্রধান বলে চিহ্নিত সেগুলি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নীতির ধারাবাহিকতার অভাব, জাতীয় উন্নয়ন কৌশলে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নানা দুর্বলতা এবং প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে বিলম্ব।

রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নয়ন অর্থনীতি-বিষয়ক কর্মকাণ্ড সমন্বয় করে পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। দেশের মুদ্রা বাজারমূলধন বাজারএর উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। এ খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ভূমিকা রাখে সেগুলি হচ্ছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং মার্চেন্ট ব্যাংক ও সমবায় ব্যাংকসমূহ। দেশের বিশেষায়িত উন্নয়ন অর্থসংস্থান প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ব্যাংক। এ প্রতিষ্ঠানগুলি সবই রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের। তবে বেসরকারি খাতেও এখন উন্নয়ন সংস্থানে কার্যকর ভূমিকা রাখে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেমন, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, সৌদি-বাংলাদেশ ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল কোম্পানি (সাবিনকো), মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্টেন্স সোসাইটি (মাইডাস), ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রমোশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (আইপিডিসি), ইউএই-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, জিএসপি ফিন্যান্স কোম্পানি এবং বণিক বাংলাদেশ। উন্নয়ন অর্থসংস্থান প্রতিষ্ঠানসমূহের তালিকায় বেশকিছু লিজিং কোম্পানির নামও উল্লেখযোগ্য। এগুলি হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিজিং কোম্পানি (আইডিএলসি), ইউনাইটেড লিজিং কোম্পানি, ফনিক্স লিজিং কোম্পানি, বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস। এ ছাড়াও আছে বিভিন্ন বীমা কোম্পানি যেমন, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানি, গ্রিন-ডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানি, পিপলস ইন্সুরেন্স কোম্পানি, জনতা ইন্সুরেন্স কোম্পানি এবং ইস্টল্যান্ড ইন্সুরেন্স কোম্পানি।

বাংলাদেশে উন্নয়ন অর্থসংস্থান প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে এনজিওদের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ব্যাপকসংখ্যক এনজিও এখন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে এবং তাদের এ কর্মসূচি জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, দরিদ্র ও বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষমতায়ন, সাক্ষরতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাদান ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, পরিবার পরিকল্পনার প্রসার এবং পরিবেশ প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত কার্যক্রমসহ সমন্বিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এনজিওসমূহের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি দরিদ্রদের জন্য মূলধনের উৎস হিসেবে কাজ করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী এগুলি থেকে স্বকর্মসংস্থান ও উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বৈষয়িক জামানত ছাড়াই ঋণ পেতে পারে। এরূপ অর্থসংস্থান দরিদ্রদেরকে নিজেদের আয় বাড়াতে সাহায্য করে এবং একইসঙ্গে, নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প জাতীয় কৃষি-বহির্ভূত কর্মতৎপরতা বিকাশে ভূমিকা রাখে।

এনজিওসমূহের উন্নয়ন অর্থসংস্থানের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন, এরা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে, দরিদ্রদের দোরগোড়ায় অর্থসংস্থান পৌঁছিয়ে দেয় এবং মূলধন সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিশেষ সেবাও দিয়ে থাকে। এর ফলে ঋণগ্রহীতাদের সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধি পায়, তারা ব্যবসায়ে উদ্বুদ্ধ হয়, তাদের আস্থা বাড়ে এবং তারা অল্পবিস্তর কারিগরি দক্ষতা অর্জন করে। এনজিওগুলি স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করেই তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার যথাসাধ্য চেষ্টা করে বলে একটা ধারণা প্রচলিত থাকলেও বস্তুত বড় এনজিওগুলির প্রায় সবাই এবং ছোটগুলিরও একটি বিপুল সংখ্যা বিদেশি সাহায্য নিয়েই নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করে। এনজিওগুলি অনেক সময় সরকারের উপ-ঠিকাদার হিসেবে সরকারি সম্পদ নিয়ে সরকারি সেবা জনগণের নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়ার এজেন্ট রূপে কাজ করে। এনজিওদের জন্য এরূপ উপ-ঠিকাদারি খাত হচ্ছে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, মৌলিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, স্বকর্মসংস্থান ও উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ড, সামাজিক বনায়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। এক অর্থে এসব সক্রিয় কর্মকাণ্ডের জন্য এনজিওসমূহ উন্নয়ন অর্থসংস্থান ও উন্নয়ন কাজে সরকারের সহযোগী ও সম্পূরক ভূমিকাই পালন করছে। [এস. এম মাহফুজুর রহমান]