উইপোকা

উইপোকা (Termite)  হালকা হলুদ বা ফ্যাকাশে রঙের নরম দেহবিশিষ্ট Isoptera বর্গের এক দল সামাজিক পতঙ্গ। উইপোকা প্রধানত গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশসমূহে বাস করে। অধিকাংশই ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি আকারের, লম্বায় ৪-৫ মিমি; তবে গ্রীষ্মমন্ডলের কোনো কোনো রানী উই ৭০ মিমি পর্যন্ত লম্বা হয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে উইপোকাদের প্রায় ১৯০০ প্রজাতির বর্ণনা হয়েছে। সেলুলোজভুক (cellulose) এসব পতঙ্গ একটি সামাজিক কাঠামোতে দল বেঁধে বাস করে এবং নানাভাবে নিজেদের কর্মকান্ড ভাগ করে নেয়। কাজের দায়িত্ব ভাগাভাগির সঙ্গে দেহের গঠনগত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে এদের মধ্যে বহুরূপিতার উদ্ভব হয়েছে। এদের এক জাতের সদস্য প্রজননক্ষম (primary reproductives), এদের রাজা এবং রানী বলা হয়। অন্যান্য ছোট আকারের উইপোকা কর্মী (worker) এবং সেনা (soldier) উই হিসেবে পরিচিত। এরা তাদের বাসার বা কলোনির পৃথক পৃথক কাজকর্ম সম্পন্ন করে।

সাদা রঙের দেহ এবং পিঁপড়াদের মতো সামাজিকভাবে কলোনিবদ্ধ জীবন কাটায় বলে অনেক সময় উইদের সাদা  পিঁপড়া বলা হলেও তা সঠিক নয়। এরা পিঁপড়াও নয়, পিঁপড়াদের সঙ্গে নিকট সম্পর্কও নেই। উইপোকা পৃথিবীতে এসেছে পিঁপড়ার চেয়ে অনেক আগে, আজ থেকে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে। এদের জীবাশ্ম সংগৃহীত হয়েছে প্রায় ১২ কোটি বছর পূর্বের ক্রিটাসিয়াস যুগের শিলা থেকে। দেহের গঠনেও পিঁপড়া আর উইপোকার মধ্যে পার্থক্য আছে। পিঁপড়াদের পেটের গোড়ার দিকে থাকে কোমরের মতো একটি অংশ যা উইপোকাতে নেই। উইপোকার শরীর নরম, মাথা ছাড়া দেহের বাকি অংশের রং হালকা হলুদ, আর পিঁপড়ার শরীর শক্ত, রং গাঢ়।

উইপোকা

উইপোকার মুখোপাঙ্গ খাদ্যবস্ত্ত চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী, অ্যানটিনা মনিলিফর্ম (moniliform) অথবা ফিলিফর্ম (filiform) ধরনের। কেবল মুখ্য প্রজননক্ষম উইপোকার দু’জোড়া ডানা থাকে। উভয় জোড়া ডানার অবয়ব, দৈর্ঘ্য এবং শিরাবিন্যাস একই রকম। বছরের কোনো এক সময় বাসায় প্রচুর পরিমাণ রাজা আর রানী উই তৈরি হয়। সাধারণত সন্ধ্যের দিকে ঝাঁক বেঁধে বাসা থেকে বের হয়ে তারা আকাশে উড়ে। এ সময়ই তারা জোড়া বাঁধে। এক সময়ে তাদের ডানাগুলি গোড়ার দিকে ভেঙে খসে যায়। উইদের রূপান্তর অসম্পূর্ণ ধরনের। একটি নিম্ফ যে কোনো জাতের উইপোকা হিসেবে বড় হতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে রানী অথবা সেনা উইয়েরা এক ধরনের হরমোনের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন জাত নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বর্ণতন্ত্র (caste system) নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল সম্বন্ধে অনেক মতবাদ আছে।

একটি কলোনিতে প্রজননের কার্যাদি পালন করে রাজা এবং রানী; সাধারণত একটি বাসায় এদের মাত্র এক জোড়া সদস্য থাকে। এদের দেহ কাইটিনযুক্ত, গাঢ় রঙের এবং পুঞ্জাক্ষী থাকে। একটি বাসার অধিকাংশ সদস্য শ্রমিক ও সেনা উই। এতে স্ত্রী-পুরুষ উভয় ধরনের উইপোকা থাকলেও তারা বন্ধ্যা, অন্ধ এবং ডানাবিহীন। অনেক প্রজাতিতে একাধিক ধরনের সেনা উই থাকে। তবে একটি বাসায় সেনা উইদের চেয়ে শ্রমিক উইয়ের সংখ্যা সব সময় বেশি থাকে। বাসা নির্মাণ, মেরামত, খাদ্য সংগ্রহ, শাবকদের লালন পালন ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের কাজ করে শ্রমিকেরাই। সেনা উইদের মাথা ও ম্যান্ডিবল হয় অনেক বড়। বাসার নিরাপত্তা রক্ষায় তারা বিশেষভাবে অভিযোজিত।

উইপোকা নানাভাবে বাসা তৈরি করে। এদের অনেকেই আর্দ্র মাটির নিচে, আবার কেউ কেউ শুকনা মাটির উপরিভাগে বাসা বানায়। উষ্ণ এলাকার অনেক প্রজাতির মূল বাসা থাকে মাটির তলায়, তা অনেক সময় মাটির উপরে উঠে নানা আকৃতি নেয়। উইপোকার এ ধরনের বাসাকে বলা হয় উইয়ের ঢিবি (termitaria)। প্রজাতি ভেদে ঢিবি হতে পারে বিভিন্ন আকারের, নানা পরিমাপের; বাসা তৈরীর কলাকৌশলও অতি বিচিত্র। সেলুলোজ উইপোকাদের খাদ্য, আর এ খাদ্য হজমে সহায়তা করে তাদের অন্ত্রে বসবাসকারী এক ধরনের ফ্লাজেলাবিশিষ্ট  প্রোটোজোয়া

উইপোকার ঢিবি


একটি কলোনিতে প্রজননের কার্যাদি পালন করে রাজা এবং রানী; সাধারণত একটি বাসায় এদের মাত্র এক জোড়া সদস্য থাকে। এদের দেহ কাইটিনযুক্ত, গাঢ় রঙের এবং পুঞ্জাক্ষী থাকে। একটি বাসার অধিকাংশ সদস্য শ্রমিক ও সেনা উই। এতে স্ত্রী-পুরুষ উভয় ধরনের উইপোকা থাকলেও তারা বন্ধ্যা, অন্ধ এবং ডানাবিহীন। অনেক প্রজাতিতে একাধিক ধরনের সেনা উই থাকে। তবে একটি বাসায় সেনা উইদের চেয়ে শ্রমিক উইয়ের সংখ্যা সব সময় বেশি থাকে। বাসা নির্মাণ, মেরামত, খাদ্য সংগ্রহ, শাবকদের লালন পালন ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের কাজ করে শ্রমিকেরাই। সেনা উইদের মাথা ও ম্যান্ডিবল হয় অনেক বড়। বাসার নিরাপত্তা রক্ষায় তারা বিশেষভাবে অভিযোজিত।

উইপোকা নানাভাবে বাসা তৈরি করে। এদের অনেকেই আর্দ্র মাটির নিচে, আবার কেউ কেউ শুকনা মাটির উপরিভাগে বাসা বানায়। উষ্ণ এলাকার অনেক প্রজাতির মূল বাসা থাকে মাটির তলায়, তা অনেক সময় মাটির উপরে উঠে নানা আকৃতি নেয়। উইপোকার এ ধরনের বাসাকে বলা হয় উইয়ের ঢিবি (termitaria)। প্রজাতি ভেদে ঢিবি হতে পারে বিভিন্ন আকারের, নানা পরিমাপের; বাসা তৈরীর কলাকৌশলও অতি বিচিত্র। সেলুলোজ উইপোকাদের খাদ্য, আর এ খাদ্য হজমে সহায়তা করে তাদের অন্ত্রে বসবাসকারী এক ধরনের ফ্লাজেলাবিশিষ্ট  প্রোটোজোয়া

প্রায় সব প্রজাতির উইপোকাই ক্ষতিকর। বাংলাদেশে এদের লক্ষণীয় ক্ষতির মধ্যে পড়ে বাঁশ এবং কাঠের খুঁটি,  আসবাবপত্র, বাড়িঘরের  কাঠ বা বাঁশের তৈরি অংশ, পাটশোলার বেড়া, বইপুস্তক, কাপড়চোপড়, নানা  ফসল, গাছপালা এবং আরও অনেক সামগ্রী খেয়ে নষ্ট করা। দেয়ালের ফাঁকে বা গাছের ফোঁকড়ে এদের তৈরি বাসা কখনও কখনও প্রসারিত হয় নানা দিকে। এদের উপকারী ভূমিকার মধ্যে রয়েছে মরা গাছপালা এবং কাঠের গুড়ি খেয়ে তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া; এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে।

উইপোকাদের পাঁচটি অথবা ছয়টি গোত্রে ভাগ করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ১০০ প্রজাতির উইয়ের কথা জানা গেলেও বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৪০টি প্রজাতির বর্ণনা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ সংখ্যা দেশের মোট প্রজাতির একটি অংশ মাত্র। ফসল বা অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ গাছপালার ক্ষতি করে এমন প্রজাতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাটের ক্ষতিকর উইপোকা Microtermes obesi এবং Odontotermes obosus; আখের ক্ষতিকর প্রজাতি Odontotermes parvidens, O. lokanardi এবং Microtermes obesiচীনাবাদাম আক্রমণকারী Termes laprobanses এবং  চা গাছ আক্রমণকারী Microtermes-এর এক প্রজাতি। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি প্রজাতি শালবনের ক্ষতি করে।  [এস.এম হুমায়ুন কবির এবং এম ওয়াহিদ বকস]